একটি ট্রেন লাইনের মৃত্যু

আমাদের একটা ট্রেন ছিল। অনেক দিন আগেই সে মারা গেছে; মেরে ফেলা হয়েছে! এই সেদিন পত্রিকান্তরে জানা গেল, শেষকৃত্য হয়ে গেছে আমাদের সেই ছোট্ট, শান্ত ট্রেনলাইনটার। হবে না কেন? আর কত কাল এই বোঝা বইবে সরকার? শেষ পর্যন্ত নিলামটিলাম করে কাদের যেন দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, রূপসা-বাগেরহাট রেললাইনটা খুঁচিয়ে তুলে ফেলার।

একজন সিদ্দিকুর এবং যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস

তারিখটা মনে নেই। রেডিসন হোটেলের ঘটনা। মঞ্চে বসে আছেন তিন বাহিনীর প্রধান। তাদের পাশে একটু সংকুচিত হয়ে বসে আছেন কালো একটি ছেলে; ছেলেটির মুখ থেকে দীপ্তি ঠিকরে বের হচ্ছে। সেনাপ্রধান বক্তৃতা দিতে উঠলেন। দর্শকসারিতে চেয়ে বললেন, ‘এখানে কি সিদ্দিকের মা আছেন?’

কোচ সমাচার

‘কোচ দুই ধরনের। এক দল বরখাস্ত হয়েছে। আরেক দল বরখাস্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে।’ কথাটা নিশ্চয়ই এর মধ্যে কয়েক হাজার বার শুনে ফেলেছেন। শুনুন বা না-ই শুনুন, কোথাও কোনো কোচ বরখাস্ত হলে পত্রিকায় তো পড়েছেন নিশ্চয়ই? কিন্তু কোচরা এমন ঘন ঘন ছাঁটাই হন কেন?

প্রফেসর ইউনুস ও দুর্নীতি এবং আমাদের ভাবমূর্তি

শেখ হাসিনা মধ্যবিত্ত ঝগড়াটে মহিলার মতো আচরণ করে ইউনুস সাহেবের সত্যিকারের কোনো ক্ষতি করতে পারেননি। আর্থিক ও জনপ্রিয়তার বিচারে ইউনুস সাহেবের লাভই হয়েছে।

এক খামখেয়ালি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন

তিনি বেস্টের মতো খামখেয়ালি, মোৎজার্টের মতো শিল্পী, হিটলারের মতো ইহুদিবিদ্বেষী-নারীবিদ্বেষী এবং আলীর মতো চ্যাম্পিয়ন। তিনি রবার্ট জেমস ফিশার বা ববি ফিশার, দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন! নিয়মতান্ত্রিক এই দুনিয়ার প্রতি অনিয়মের এক প্রবল পরিহাস।

বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই, ২০১১

আগুন খেলা



পরিমল মড়া পোড়ায়। পরিমল পেশায় ডোম না। তারপরও মড়া পোড়ায়। শুধু পোড়ায় না পরিমল শ্মশানেই থাকে। পরিমল গাঁজা খায় না। তারপরও শ্মশানে থাকে। কেন শ্মশানে থাকে? কেউ জানে না। পরিমল আগে শ্মশানে থাকতো না। এখন থাকে। মরে ফেরার পর থেকে শ্মশানেই থাকে।
পরিমল মরে গিয়েছিল। ঠিক মরে গিয়েছিল, বলা যায় না। বলা যায় পরিমল হারিয়ে গিয়েছিল।
পরিমল তো আর সোনার আংটি নয়। তাই সে হারানোর সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে খোজ খোজ পড়ে যাওয়ারও কোন কারন নেই। ছেলে হিসেবে পরিমলকে অনেকেই পছন্দ করতো। এ কাজে ও কাজে, এ বাড়ি ও বাড়ি তার একটা ভুমিকাও ছিল। কিন্তু এতো গুরুত্বপূর্ন কোন লোক না যে, তার হারিয়ে যাওয়াতে ঢি ঢি পড়ে যাবে।
আসলে পরিমলকে নিয়ে ঢি ঢি ফেলার লোকই বা কৈ। সাকুল্যে এ্ই দুনিয়ায় তার নিকটজন বলতে মা। বাবা মারা গেছে নাকি ছেড়ে গেছে এ ব্যাপারটা পরিমল নিজেও নিশ্চিত ছিল না। তার মায়ের আর কোন ছেলে নেই।
মেয়ে ছিল একটা। মানে পরিমলের বছর দশেকের বড় বোন শিখা। সেও চতুর্থ মেয়ে জš§ দিতে গিয়ে বাপের বাড়ি বসে মরেছে। ফলে পরিমলের জন্য পাড়া মাথায় করার মত লোক আছে ওই মা। তার আবার ইদানিং বাতের ব্যাথায় পাড়া মাথায় করার শক্তিটা নেই। তাই পরিমল হারানোতে কারও তেমন কিছু গেল এল না।
শুধু পাড়ার মোড়ের নারায়নের চা’র দোকানে এক দুদিন আলোচনা হল, ‘আচ্ছা, পইরেডা যাতি পারে কোহানে?’
এও এক কথা। পরিমলের যাওয়ার যায়গাটা কোথায়? ইহজগতে তার কোন বন্ধু-বান্ধব আছে বলে শোনা যায়নি। যার বাড়িতে যেতে পারে পরিমল। কেউ কেউ অবশ্য বললো, ‘মনে হয় ইন্ডিয়ায় গেছে।’
পরিমলের ভারতে যাওয়ার পে কিছু যুক্তিও আবিষ্কার হয়ে গেল। তাকে নাকি কয়েকদিন আগে নিবারন দালালের সঙ্গে হাটের কোনায় ফিস ফিস করতে দেখা গেছে। আবার এও জানা গেল, পরিমলের ভারতে গিয়ে একটা দোকানে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনার কথাও নাকি জানা গিয়েছিল।
এতসব সম্ভাবনার ইতি টেনে দিল দোকানদার নারায়ন নিজে, ‘ওরে ওর বাপ ছিল ওইরকম। আজ আছে তো কাইল নেই। এই কইরে কইরে তো শেষবার আর ফিরলই না। পইরেও দ্যাখ বাপের মত লাফাঙ্গা হইয়ে গেছে।’
সর্বজনগ্রাহ্য এমন সমাধানের পর আর কথা চলে না। তাই পরিমলের হারিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটা একরকম হারিয়েই গেল।
পরিমলের প্রসঙ্গটা আবার চাড়া দিয়ে উঠল সেবার শীতের আগে আগে। বছর খানেক আগের ঘটনা হওয়াতে পরিমলের কথা অনেকেরই আর মাথায় নেই। তাই নিবারন দালাল এসে যখন পরিমলের মৃত্যু সংবাদ দিল, সবাই বেশ চমকেই উঠল।
কেউ কেউ একটু আহা উহু করে ঘটনাটা জানতেও চাইল। নিবারন যত না আসল ঘটনা বললো তার চেয়ে নিজের কাধ থেকে দায় কমাল বেশি, ‘আমি ওরে বার বার কলাম, খারাপ কাজের মধ্যি যাইসনে। ওপারে যাইয়ে একটা দোকানের কাজেও লাগায়ে দেলাম। ও সেয়া ছাইড়ে দিয়ে কোহানে কোন চালানের ব্যাবসা শুরু কইরল।’
প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে নিবারন যা বললো তার সারমর্ম, ভারত থেকে বাংলাদেশে মাল চোরাচালান করতে গিয়ে বিডিআর বা বিএসএফের গুলি খেয়ে মরেছে পরিমল। লাশ আনার চেষ্টা করেছিল বলেও সজোরে দাবি করলো নিবারন।
পরিমলের স্মৃতি এমনিই ঝাপসা হয়ে এসেছিল। ফলে একটু আহা উহুতেই শেষ হয়ে গেল সে শোক। কেবল পরিমলের বাতের ব্যাথায় ভোগা মা দিন দুয়ের চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলে রাখল। এরপর যে-ই কে সেই। প্রতি সন্ধে বেলা শুধু পরিমলদের বাড়ির ভেতর থেকে ওর বুড়ো মায়ের গোঙ্গানির শব্দ ভেসে আসতে থাকে। এবার আসলেই হারিয়ে গেল পরিমল।
সেদিন সন্ধে বেলাতেও অমন গোঙ্গানির শব্দ করে কাঁদছিল পরিমলের মা। রাস্তায় মানুষের মুখ চেনার মত আলো তখন আর নেই। অমন সময় ফিরে এল পরিমল। ব্যাপারটা যত নাটকীয় হতে পারত তা হল না। স্রেফ বারন্দার নিচে দাড়িয়ে পরিমল ডাক দিল, ‘ও মা। দরজা খোলো।’
পরিমলের মা অস্বাভাবিক এই প্রাপ্তিতে বিষ্ময় প্রকাশ করতেই ভুলে গেলেন। প্রথম চোটটা সামলে নেওয়ার পর শুরু হল পরিমলের মায়ের পাড়া মাথায় তোলা।
তার প্রবল চিৎকারে আশে পাশের লোকজন তো মারাত্মক অবাক! ব্যাপার কী। পরিমল তো একবার মরেছে। এবার আবার কে মোলো? কে মরল সেটা দেখতে এসে লোকজন আবিষ্কার করলো, পরিমলের প্রত্যাবর্তন।
পরিমলের প্রত্যাবর্তনে যতটা হৈ চৈ পড়ার কথা তা পড়ল না। এরকম হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসার নজির পরিমলের বাবা এতবার স্থাপন করেছে যে, লোকজন আর অবাক হয়ে পেরে ওঠে না।
তবে পরিমলের ব্যাপারে একটু মজা ছিল। কারন, সে তো হারিয়ে ফিরে আসেনি। এসেছে মরে গিয়ে। ফলে অবধারিতভাবেই পরিমলের কাছে সবার প্রশ্ন, সে মরেও ফিরল কি করে। পরিমল কথা বলে না।
নারায়ন দোকানদার যখন জোর চাপ দিল তখন একবার মুখ খুললো পরিমল। অনেক চাপাচাপির পর শুধু বললো, আমি তো মরিনি।
তারপরও কত প্রশ্ন, ‘না মরলি এতদিন ছিলি কোহানে? না মরলি নিবারন তোর লাশ দেইখল কোহান্দে?’
পরিমল আবার চুপ মেরে যায়। অনেক ধমক দেওয়ার পর একবার বলে, ‘নিবারনকা ভুল দেহিছে। গাজা খায় তো।’
এবার অবশ্য অনেকেই মেনে নেয়। কারন নিবারনের গাজা খাওয়ার ব্যাপারটা সর্বজনবিদীত। এই যুক্তি দেওয়াতে পরিমলের না মরা নিয়ে কারও আর সন্দেহ থাকে না। প্রায় সবাই মেনে নেই পরিমল মরেনি।
অবশ্য পরিমলের কাদম্বীনির মত কোন দুশ্চিন্তা ছিল না। তার মরে প্রমান করার দরকার ছিল না, সে জীবিত। সে মৃত হলেও কারও কিছু যায় আসে না। তারও কিছু যায় আসে না। তাই দিন কয়েক কাটার পর পরিমলের মরে ফেরা নিয়ে গ্রামের আর কারো তেমন আপত্তি থাকল না।
শুধু হঠাৎ হঠাৎ কারো মনে পড়ে গেলে, হয়তো জিজ্ঞেস করতো, ‘কি রে পইরে, তুই মরার পর ফিরে আসলি কেমন কইরে?’
পরিমল এখন আর এই প্রশ্নের উত্তরে কোনো কথাও বলে না, চুপও থাকে না। সে একটা রহস্যময় হাসি শিখে গেছে। কেউ কোন প্রশ্ন করলেই এই রহস্যময় হাসিটা দেওয়া শুরু করল।
গায়ের মানুষ এত নির্বোধ না। পরিমল রহস্যময় হাসি দিল, আর লোকেরা বিভ্রান্ত হলোÑতা হয় না। পরিমলের আগের মতই দিন কাটতে লাগল। আগের মতই এ বাড়ি ও বাড়ি, এ কাজে ও কাজে পাওয়া গেল পরিমলকে।
আগের মত শীতের সময় সিদ্দিকের ক্রিকেট দলে খেলতে নেমে গেল। পরিমল আগেই মতই থাকল। কিন্তু কিছু সু পরিবর্তন হয়ে গেল পরিমলের মধ্যে। আগের মতো সব কাজে উৎসাহ দেখায় না। এখন পরিমল নিজের মতো চলে।
পরিমলের সুক্ষ পরিবর্তনটা খুব স্থুল হয়ে ধরা পড়ল ওই ক্রিকেট খেলতে গিয়ে। পরিমল যেদিন প্রথম সিদ্দিকের দলের হয়ে আবার মাঠে নামল সেদিনই ধরা পড়ল। আগে পরিমল ডান হাতে ব্যাট ধরত। এদিন পরিমল বাঁ হাতে ব্যাট নিয়ে দাড়াল। সিদ্দিকরা খুবই অবাক হল।
পরিমল শুধু বাহাতে ব্যাট করলো, তাই না। পরিবল বলও করলো বাম হাতে। আগে পরিমল বলই করতে পারতো না। আর এবার উত্তর পাড়ার সঙ্গে খেলায় পরিমল সেধে বললো, ‘সিদ্দিক, আমারে এট্টু বল করতি দে।’
সিদ্দিক চটে বলেছিল, ‘ধুর, তুই তো বল করতি পারিস না।’
‘পারবানে। দিয়ে দ্যাখ।’
পাড়ায় পাড়ায় খেলা। এমন বড় কিছু না। তাই সিদ্দিক বল দিয়েছিল পরিমলের হাতে। সে রীতিমতো ওয়াসিম আকরামের মতো বল করলো; যদিও সিদ্দিকরা কেউ ওয়াসিম আকরামকে চিনতো না।
দেখতে দেখতে পরিমল ফট ফট করে ৪ টে উইকেট নিয়ে নিল। বাম হাতের বল; তায় আবার কী জোর। সিদ্দিক এবার ম্যাচ শেষ হওয়ার পর খুব চেপে ধরলো পরিমলকে, ‘কি রে, পইরে। তুই এরম বাহাতি হলি কেমন কইরে? আর বল করা শিখলি কোহানে?’
পরিমল সেই রহস্যময় হাসি হেসে বলে, ‘ওই তো শিহে আইছি।’
তা একরকম হতেও পারে। পরিমল ইন্ডিয়া গিয়েছিল, মরে গিয়েছিল। ফলে সে নতুন অনেক কিছুই শিখে ফিরতে পারে। মেনে নিল সিদ্দিকরা। ডান হাতি পরিমল যে বা-হাতি হয়ে গেল তা নিয়ে কেউ কোন আপত্তি করল না।
পরিমলের মাও আপত্তি করলেন না। কিছু সু-স্থুল পরিবর্তন তার চোখেও ধরা পড়ে। আগে পরিমল রাতের বেলা ঘর থেকে বের গত না। এখন পরিমল রাতের বেলায় কোথায় না কোথায় ঘুরে বেড়ায়। বাতের ব্যাথায় ভোগা মায়ের আপত্তি, চিল্লাপাল্লা কিছুই কানে তোলে না। শুধু হাসে।
পরিমলের মা খেয়াল করেন, কেমন যেন বদলে গেছে ছেলেটা। সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা হল, পরিমল মড়া পোড়াতে গেল।
গাও গেরামের মড়া পোড়াতে তো আর ডোম লাগে না। এলাকার লোকজনেই চিতে সাজিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। পরিমল ওই লোকজনের সঙ্গে মিশে গেল। যেখানেই যে বুড়ো বা জোয়ান মরুক, পরিমল মিশে যায় মড়া পোড়ানোর দলে।
হাতে একটা বাশের লাঠি নিয়ে দিব্বি বাড়ি দিয়ে আধপোড়া মড়ার মাথাটা ফাটিয়ে দেয়। ঘন্টা চারেক ধরে একটু একটু করে খুচিয়ে শেষ করে পোড়ানো। কয়েক মাসের মধ্যে মড়া পোড়ানোর জন্য আলাদা একটা সুনাম হয়ে গেল পরিমলের।
এখন আর তাকে মড়া খুজতে হয় না। কোথাও কেউ মরলে তার বাড়ির লোকজনই পরিমলকে খবর দেয়। পরিমলও মহা আনন্দে বাশের লাঠি নিয়ে ছুটে যায় শ্মশানে। এই করতে করতে শ্মশানই পরিমলের বাসস্থান হয়ে দাড়াল।
এখন পরিমল দিনের বেলা ক্রিকেট খেলে; বা হাতে ব্যাট করে, বাম হাতে বল করে ৪-৫ উইকেট পায়! আর বিকেল থেকে মড়া পোড়ায়। রোজ রোজ তো মড়া জোটে না। যেদিন মড়া আসে না, সেদিন শ্মশানেই পড়ে থাকে। ভালোই চলছিল পরিমলের এই জীবন।
বাগড়া দিল নিবারন। পরিমল ফিরে এসেছে শুনে হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটে এল নিবারন দালাল। সন্ধে বেলায় নারায়নের চা’র দোকানে কেবল ভীড় জমে উঠেছে।
নিবারন ছুটে এসে বললো, ‘ও নারায়নদা। পইরে নাই ফিরে আইছে?’
নারায়ন বিষ্মিত হয়ে বলে, ‘হ, আইছে! তুই তো কলি মইরে গেছে। তুই শালা এট্টা পাষন্ড। রাইতদিন গাজা খাইস। জ্যান্ত ছলডারে মাইরে ফেললি!’
নিবারন চটে ওঠে। বোঝানোর চেষ্টা করে, সে প্রায় দুদিন ধরে গাজা খায় না, ‘শোনো নারায়নদা। আমি নিজির চোহে পইরের লাশ দেহিছি।’
নারায়ন এবার হাত উচুকরে, ‘ধুর হ, শালার গাজাখোর। ও নিজি দেহিছে..হুহ!”
ভেংচি কেটে নারায়ন চা বানানোয় মন দেয়, ‘তোর বিশ্বেস না হলি কালিতলা শ্মশানে যাইয়ে দেখ। পইরে আছে ওইহেনে। ওই পাড়ার শিবু মরিছে। তারে পোড়াতিছে।’
নিবারন আরও এক দুবার কথা বলার চেষ্টা করে। কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। উঠে পড়ে নিবারন। রাস্তায় এসে ভাবে, দেখেই যাই পরিমলকে। পা বাড়ায় শ্মশানের দিকে।
হন হন করে হেটে চলে নিবারণ। নারায়নের চায়ের দোকান থেকে শশ্মান খোলা এমন কিছু দুর না। স্কুল মাঠ, তারপর উত্তরের খোলা, তারপর খাল পার হলেই শ্মশান।
খালে সাকোর ওপর দাড়িয়েই গন গন করে জ্বলতে থাকা চিতের আগুন দেখতে পায় নিবারণ। বুঝতে পারে, ওখানে পইরে আছে।
পরিমল একাই ছিল শ্মশানে। শিবুর অপদার্থ ছেলেদুটো বাপের মুখে আগুন দিয়েই চলে গেছে বাড়ি। আবার বাবার পোড়া শেষ হলে আসবে। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা শিবুর চিতার পাশে হাতে লাঠি নিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে পরিমল।
পেছন থেকে হঠাৎ ভেসে আসে নিবারনের হাক, ‘ও পইরে!’
একটু চমকে ওঠে পরিমল। মরে ফেরার পর এই প্রথম চমকে ওঠে। নিবারন আরেকটু কাছে এসে খেপে ওঠে, ‘তুই নাকি মইরে ফিরে আইছিস?’
পরিমল কোনো কথা বলে না। চুপচাপ লাঠিতে লাঠিতে ভর দিয়ে দাড়িয়ে থাকে। নিবারনের চোখে তাকায় না। পায়ে ভরটা বদল করে লাঠি বাড়িয়ে আগুনে কয়েকটা খোচা দেয়।
নিবার আরও খেপে ওঠে, ‘কথার উত্তর দিসনে কেন? তুই মইরে ফিরলি কি করে! ক শুয়োরের বাচ্চা।’
পরিমল কথার উত্তর দেয় না। এক মনে আগুন খোচাতে থাকে। নিবারন আরও কাছে চলে আসে। চিৎকার করে বলে, ‘তুই কি ভাবিছিস গ্রামের লোক বলদ? তুই কি ভুত! ক শালা, তুই ভুত?’
এবার পরিমল একটু হাসেÑসেই রহস্যময় হাসি।
হাসি দেখে আরও চটে ওঠে নিবারন। পরিমল আর চিতার মাঝখানে এসে দাড়ায়। চোখ দুটো লাল করে পরিমলের দিকে তাকায়। ফ্যাস ফেসে গলায় চাপ স্বরে শক্ত ঝাড়ি দেয়, ‘ভুত! নিজিরি ভুত ভাবিস? ভুত হওয়া এতো সোজা! ভুত হলি আগুন লাঠি দিয়ে খোচাস কেন? হাত দিয়ে ধর।’
পরিমল আবার হাসে। এই প্রথম উত্তর দেয়, ‘তুমি জানো না, ভুত আগুন ছুতে পারে না।’
নিবারনের লালবর্ন চোখ দুটো যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। আরও চাপ স্বরে কঠোর গলায় বলে ওঠে, ‘কোন হারামজাদা কইছে, ভুতে আগুন ছুতি পারে না? এই দ্যাখ শালা....’
নিবারনের হাতে চিতা থেকে তুলে আনা এক গাদা গনগনে কয়লা। একমুঠো গন গন করে জ্বলতে থাকা আগুন হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকে খেপা নিবারন।

বুধবার, ২০ জুলাই, ২০১১

বাবাকে মনে পড়ে

বাবা ঠিক আমাদের চেনা-জানা জগতের মানুষ ছিলেন না।
আমাদের জগতের মানুষগুলোর মতো স্ত্রী-সন্তান-পরিবার-আত্মীয়স্বজন-অর্থ-ভবিষ্যত নিয়ে বাবা কখনো চিন্তিত ছিলেন না।
বাবা কখনো আমাদের পড়তে বসতে বলেননি। বাবা কখনো আমাদের জন্য হাতে করে একটু খাবার বা খেলনা নিয়ে বাড়ি ফিরতেন না। বাবা কখনো বলতেন না, তোরা তো বখে যাচ্ছিস!
বাবা সরকারী চাকরি করতেন; বেশ বড় চাকরি।
গল্প শুনেছি, বাবা নাকি আমাদের তিন ভাইয়ের নাম জানতেন না। জীবনের বিরল কীর্তি হিসেবে বাড়িতে একবার চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে আমাদের লিখেছিলেন: শিব, নারায়ন আর কার্তিক কেমন আছে? উদ্দেশ্য আমাদের তিন ভাইয়ের খবর নেওয়া।
কিন্তু সত্যিটা হল, আমাদের নাম কোনোকালেই শিব-নারায়ন-কার্তিক ছিল না। ধরেই নেওয়া যায়, বাবা আমাদের নাম মনে রাখতে পারতেন না।
বাবার সঙ্গে ছোটবেলায় আমাদের দেখা-সাক্ষাতই খুব একটা হয়ে উঠতো না। দেবহাটা, কলারোয়া, পাটকেলঘাটা, আশাশুনি....আরও কোথায় কোথায় যেন চাকরি করে বেড়াতেন। ফলে ছোটবেলায় বাবাকে দেখায় খুব একটা হয়ে উঠতো না।
বৃহষ্পতিবার গভীর রাতে বাবা বাড়ি ফিরতেন; শুক্রবার সকালে উঠে আবিস্কার করতাম আমরা। সে আবিস্কারে বিরাট কোনো ফূর্তি ছিল না; কোনো ভয়ও ছিল না। কারণ, বাবা কোনো আমোদ নিয়ে আসতেন না। কারণ, বাবা শাসন করতেন না।
বাবা এসে বাগানে চলে যেতেন। একটা দা আর একটা রেডিও। দা দিয়ে কুট কুট করে সারাটা দিন বাগান পরিস্কার করতেন। পাশে বেজে চলতো বিজ্ঞাপন-তরঙ্গ অথবা ইডেনের ক্রিকেট ম্যাচ।
ক্রিকেটের বড় পাগল ছিলেন। জাগতিক এই একটা ব্যাপারই বাবাকে টানত।
বাবার সঙ্গে আমাদের নিয়মিত দেখা হওয়া শুরু হল অবসরে যাওয়ার ক দিন আগে থেকে। বাগেরহাটে নিজেদের জেলায় পোস্টিং পেয়ে অবসরে গিয়েছিলেন। তখন বাড়ি থেকে অষিপ করতেন।
তখন আমরা একটু বড় হয়েছি। বাবাকে এড়িয়ে চলতাম। বাবা তাতে কিছু মনে করতেন না। কাছে নিয়ে আহলাদ করতে না পারলে কষ্ট পাবেন, এমন মানুষ তো ছিলেন না।
অবসরের পরে সার্বক্ষনিক সঙ্গী হয়ে গেল ওই বাগান, সবজি খেত আর রেডিও। কিসব আজব আজব সবজি চাষ করতেন। কখনো চীনা বাদাম, কখনো তরমুজ, কখনো পেস্তা বাদাম!
মিথ্যাচার না করলে বলতে হয়, বাবার এসব বিচিত্র চাষের ফলন বেশিরভাগ সময়ই হতাশাজনক ছিল। তাতে বাবার উৎসাহের কমতি ছিল না। একটা বাদামের চারার পেছনে দিনটা ব্যায় করে দিতেন। সব উৎসাহ ওই চাষে আর গাভাস্কারের ব্যাটিংয়ে।
আমাদের নিয়ে একদমই উৎসাহ ছিল না। আমি তখন সিগারেট ধরেছি। কে একজন এসে নালিশ করলো, ‘তোমার ছলডা তো বিড়ি খায়।’
আমি ঘরে ঘুমের ভান করে শুয়ে শুনছি; বাবা বললেন, ‘বড় হইছে, এখন তো আর আমি নিষেধ করতে পারি না। আমিও তো নস্যি টানি; ওরা কি নিষেধ করে!’
এই আমার বাবা।
তখন বাবার সঙ্গী আমার চাচাতো ভাইটা: তন্ময়। রাতদিন ওই চাষাবাদ করতে করতে তন্ময়ের সঙ্গে বিচিত্র সব গল্প বলতেন। সুনীল গাভাস্কারের সঙ্গে তার কি কথা হল ‍কিংবা ভিভ রিচার্ডস বাবার কাছে কি জানতে চাইলেন: এসব গল্প তন্ময় হয়ে শুনতো তন্ময়।
আমরা বড় হয়ে গেছি। তখন এসব গল্প শোনার মন কই!
বাবার সঙ্গে দূরত্বটা আরও বেড়ে গেল। আমি ‘মানুষ’ হওয়ার আশায় ঢাকায় চলে এলাম। প্রথম আলোতে চাকরি করছি। হঠাৎ শুনলাম, বাবার ক্যান্সার। বাবাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হল।
নিউরোসার্জন দাদার কল্যানে চিকিৎসা বিষয়ক ব্যয় বা চিন্তা কোনোটাই আমাকে করতে হল না। শুধু রাতে পালা করে তিন ভাই থাকতাম বাবার কাছে; পিজি হাসপাতালে। থাকতে হয় বলে থাকতাম। বাবার সঙ্গে তো খাতির ছিল না।
আমি জানতাম, বাবাও আমার খোজখবর রাখেন না। আমিও রাখি না।
একদিন বাবা আমার দুনিয়াটা কাঁপিয়ে দিলেন। গভীর রাতে ফিরেছি হাসপাতালে। আমাকে দেখে মেজদা চলে গেল দাদার বাসায়। বাবা ঘুম; আমার তাই মনে হয়েছিল।
আমি চুপি চুপি পাশের বেডে ঘুমাতে যাচ্ছি; বাবার কণ্ঠ পেলাম, ‘কাবার্ডের মধ্যে একটা বক্সে পায়েস রাখা আছে। খেয়ে নিও। বড় বৌ (আমার বৌদি) এনেছে।’
আমি বললাম, ‘আপনি খাননি কেন?’
বাবা একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘না। তুমি পায়েসটা ভালো খাও তো। তাই রেখে দিলাম।’
আমার চেনা বাবার জগতটা মিথ্যে হয়ে গেল।
আমি পায়েস ভালো খাই সবাই জানে। আমার মা জানে সবার চেয়ে বেশি। আমার বন্ধুরা জানে, আত্মীয়স্বজন জানে। কিন্তু বাবার তো জানার কথা না। তিনি তো আমার নামই মনে রাখতে পারেন না!
বাবা কি করে জানলেন আমার পায়েস ভালো খাওয়ার কথা?
প্রশ্নটা করা হয়নি। ভেবেছিলাম, একদিন চুপি চুপি জিজ্ঞেস করবো। তার আগে বাবার কাকুতিতে তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হল।
একদিন ভোর রাতে ফোন এলো, বোড়ি যেতে হবে। বুঝলাম, বাবা নেই। শেষ বেলায় নাকি আমার নাম করে ডাকছিলেন।
বাবা আমার নাম জানতেন! বাবা আমার পছন্দ জানতেন!
অথচ আমার বাবাকে জানা হল না। বাবাকে প্রশ্নটা করা হল না।
রহস্যটা রেখে চলে গেলেন বাবা।

[একই বিষয় নিয়ে কাছাকাছি গদ্যে বাবা দিবসে প্রথম আলোয় একটি লেখা লিখেছিলাম। সেই লেখার কোনো কপি আমার কাছে নেই।]

মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০১১

গান



আজ (১৯ জুলাই) সাহিত্যপত্র নতুনধারায় প্রকাশিত আমার গল্প।


সোহরাব সাহেব স্কুল থেকে ফিরছিলেন। সাইকেলেই স্কুলে যাতায়াত করেন তিনি। ফেরার পথে বাজার থেকে দুই তাড়া লাল শাক আর শস্তায় পেয়ে একভাগ কুচো চিংড়ে কিনে ফেলেছেন।
বাজারটা পার হতেই হঠাৎ দেখা দীলিপবাবুর সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে সোহরাব সাহেব হিসেব করতে চেষ্টা করলেন, আজ সকালে কার মুখ দেখে ঘুম ভেঙেছিল তাঁর। মনে করতে পারলেন না। তবে লোকটা যেই হোক সে কুফা নিঃসন্দেহে। কুফা না হলে এই ভর সন্ধে বেলা মাছ-শাক কিনে ফেরার পথে দীলিপবাবুর সঙ্গে দেখা হবে কেন!
দীলিপবাবু অবশ্য অর্ন্তযামী নন। ফলে সোহরাব সাহেবের মনে মনে এই ভুত দেখার মত অনুভুতি হওয়াটা তিনি বুঝতে পারলেন। তিনি দেখলেন সোহরাব সাহেবের হাসি হাসি আন্তরিকতা ভরা মুখটা। আর শুনলেন, ‘কি দীলিপ, আছ কেমন? কলেজতথে ফিরলে কহনে?’
এমন সদালাপের ব্যাপ্তি বড়ই হওয়ার কথা। দীলিপবাবুও যথারীতি এ কথা, ও কথায় সোহরাব সাহেবের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের পর চলে আসলেন আসল কথায়, ‘তা সোহরাবদা কী বাড়ির পথ ধইরলে নাকি? এহনই বাড়ি যেইয়ে করবানে কী? ওর চেইয়ে আমাগো দিক চল’।
আতকে উঠলেন সোহরাব সাহেব। তাহলে আশঙ্কাই সত্যি হল। একটা অজুহাত দাড় করানোর চেষ্টা করলেন, ‘তা যাতি তো পারতাম। কিন্তু এই যে একভাগ মাছ কিনিছি.. এহনই না ফিরলি তো পইচে যাবেনে।’
‘ওয়া নিয়ে চিন্তা কইরো না। দেহি তোমাগো দিক কেডা যায়, তার হাতে পাঠায়ে দিচ্ছি।’-মুহুর্তে মাছের টোপলা নিয়ে রাস্তার ওধারে উধাও দীলিপবাবু। একটু পরেই একগাল হাসি সমেত হাজির, ‘এই দেহ, কাদের ভাই তোমাগো বাড়ির পরেতথেই ফেরবে। কাদের ভাইর হাতে ধরায়ে দেলাম।’
এমন সমাধানের পর আর কথা চলে না। এরপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য দীলিপবাবু কাদেরকে পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘কাদের ভাই, মাছের টোপলা তুমি বৌদির হাতে তুলে দিয়ে তারপর যাইও।’
ব্যাস। কুচো চিংড়ির ব্যপারটা নিশ্চিত! কিন্তু সোহরাব সাহেবের মাথায় তখন আর কুচো চিংড়ি নেই, আছে শুধু ছাড়া পাওয়ার চিন্তা। নিজের কয়েক শ বারের অভিজ্ঞতায় জানেন রাত গভীর না হওয়া পর্যন্ত দীলিপবাবুর হাত থেকে মুক্তি নেই। হা করে দীলিপবাবুর ভাঙ্গা হারমোনিয়ামের সঙ্গে গাওয়া, ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ’ জাতীয় গান শুনতে হবে। আর মাঝে মাঝে সমঝদারের মত বলতে হবে, ‘এই জায়গাটা তো চমৎকার তুলিছো দীলিপ!’
দীলিপ বাবু একজন শিল্পী; রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। রবীন্দ্রনাথের ওপর তার বিশেষ টান। পারলে রবীন্দ্রনাথের নাটকে অভিনয় করতেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন। তা পারেন না দীলিপবাবু। শুধু গান করেন। রেডিও, টিভিতে না; নিজে নিজেই গান করেন। বন্ধু বান্ধবকে, এলাকার লোকজনকে সে গান শোনান। সবাই যে দীলিপবাবুর গান খুব আগ্রহের সঙ্গে শোনেন তা নয়। বরং বলা চলে বেশিরভাগ লোকই দীলিপবাবুর গানের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে চান।
পালিয়ে বাঁচার ব্যাপারটা দীলিপবাবু একেবারেই বুঝতে পারেন না তা না। তবে, বিষয়টাকে তিনি পাত্তা দেন না। পাত্তা দিলে তাঁর চলে না। কারন তাকে তো গান শোনাতে হবে। তিনি একজন শিল্পী।
দীলিপবাবুর এহেন মরিয়া গান শোনানোর চেষ্টার কাছে তাই এলাকার একটু সমঝদার, অসমঝদারদের পালানোর চেষ্টা একেবারেই জলে যায়। যেমন গেল সোহরাব সাহেবের চেষ্টা। শেষ পর্যন্ত দীলিপবাবু যখন ছাড়লেন, তখন আর সোহরাব সাহেবের চৈতন্য বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। বাড়িতে ফেরার পর কুচো চিংড়ির বদলে যে মুখ ঝামটা জুটবে, সে সম্পর্কেও সোহরাব সাহেবের আর ভাবার শক্তি নেই। কেবল দীলিপবাবুদের বাড়ি থেকে বের হয়ে বললেন, ‘আল্লাহ! এই আপদ শুধু আমার ঘাড়েই ওঠে কেন?’
এ কথাটা অবশ্য সোহরাব সাহেব অন্যায় বললেন। এই আপদ অনেকের ঘাড়েই ওঠে। আসলে অনেকে তো মনে করেন দীলিপবাবুর সঙ্গীতসাধনা যত না গান ভালোবেসে, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ জ্বালানোর জন্য। এ কথার পে যুক্তিও আছে, উদাহরনও আছে।
এই যে সেবার বাড়িতে কোন উপল ছাড়াই তিন দিন, চার রাত ধরে মাইক বাজালেন দীলিপবাবু; এর কারন কী? একমাত্র মানুষকে জ্বালানো ছাড়া আর কোন কারন থাকতে পারে বলে মনে হয় না। অবশ্য দীলিপবাবুর এই কাজের পেছণে অকাট্য একটা যুক্তি ছিল, ‘আসলে সোহরাবদা বুইঝলে, আমার টেপ রেকর্ডারটা তো ভাঙা। সাউন্ড হয় না ঠিক মত। রবীন্দ্রনাথের গানের কথাগুলো বোঝা যায় না। তাই মন ভইরে গান শোনার একটা ব্যবস্থা করলাম।’
এই ব্যবস্থা করতে গিয়ে দীলিপবাবুর সাধের ইন্ডিয়ান হিরো সাইকেলটা বেচে দিতে হল। তারপরও আক্কেলের মাইকের দোকানে তার চল্লিশ টাকা বাকি থেকে গেল। সে চল্লিশ টাকা পাওয়ার আশা অবশ্য আক্কেল ছেড়ে দিয়েছে।
দীলিপবাবুর সব কারবারই যে এমন জনবিরক্তিকর তা না। এলাকার যত ইংলিশ প্যান্টপড়া ছেলে-মেয়েদের কাছে দীলিপবাবু একজন জীবন্ত বিনোদন। একেকবার এদের আনন্দের জন্য একেটা আজব বস্তু তৈরি করে ফেলেন তিনি। একবার কোথা থেকে শিখে এলেন হ্যারিকেন আর রঙ্গীন কাগজ দিয়ে বায়েস্কোপ বানানো।
শীতের সন্ধে বেলা দীলিপবাবুর বানানো সেই বায়েস্কোপ দেখে শুধু ইংলিশ প্যান্টপরা ছেলে-মেয়েরা না, বাড়ির বৌরাও বিরাট আমোদ পেল।
দীলিপবাবু ইতিহাসে সবচেয়ে আলোড়ন তৈরি করলেন চাড়িতে ভেসে। পুরোনো পেপারে এক রাশিয়ান লোকের বড় পাত্রে করে নদী পাড়ি দেওয়ার খবর পড়ে আইডিয়াটা মাথায় এসেছিল তার। হাট থেকে কিনে নিয়ে এলেন বিশাল এক চাড়ি। এই চাড়ি ব্যবহার করা হয় গরু-মোষকে খাবার দেওয়ার কাজে।
মাটির সেই পাত্র এবার খাবারের বদলে ধারন করলো দীলিপবাবুকে। নদী তো আশে পাশে নেই। তাই ভেসে পড়লেন তিনি নিজেদের বড় পুকুরেই। বেশ ভালোই চলছিল। হঠাৎ পাশ ফিরতে গিয়ে, কি কিছুৃ একটা হয়ে উল্টে গেল দীলিপবাবুর সেই বাহন। পুকুর পাড়ে রীতিমত ভীড় জমে গেল দীলিপবাবুর সেই ভাসা দেখতে।
ভীড় জমারই কথা। একে তো চাড়িতে ভাসার মত ঘটনা রোজ রোজ ঘটে না। তারওপর আবার বিএ পাশ এক আধবুড়োর এই আজব চেষ্টা। এলাকায় রীতিমত ইতিহাস!
ভালোই চলছিল এভাবে দীলিপবাবুর। একটু বেশি বয়সে হলেও বিএ পাশ করে দীলিপবাবু বেশ কাটিয়ে দিচ্ছিলেন। বাবা যা রেখে গেছেন তাতে পায়ের ওপর পা রেখে চলে না। কিন্তু ভাইদের প্রশ্রয়ে আর মায়ের ‘ও ছোটো মানুষ কী করবে’ টাইপের কথাবার্তার কারনে দীলিপবাবুর গায়ে এই ইহজাগতিক কোন প্রভাব পড়তে পারছিল না। হঠাৎ সব ভেস্তে গেল। বিয়ে হয়ে গেল দীলিপবাবুর।
বিয়েটা দীলিপবাবুর কাছে ‘হঠাৎ’।
কিন্তু বাড়ির লোকজনের আসলে বেশ আগে থেকে নেওয়া প্রস্তুতির একটা ফসল। বয়স পয়ত্রিশ-ছত্রিশ পার করে ফেলার পরও দীলিপবাবু নিজে বিয়ে নিয়ে একটুও আগ্রহী ছিলেন না। বরং বিয়ের প্রস্তাব এলে নিজের অনাগ্রহ প্রকাশে যা করার সবই করতেন। কিন্তু এবার আর কোন বাধাতে কাজ হল না।
আসলে দীলিপবাবুকে রাজী করাতে তার মাও একটু অভিনয় করে দেখালেন। একদিন রাতে বেশ মরো মরো একটা ভাব করে বললেন, ‘ও দীলিপ, আমার তো আর সময় নেই। তুই এট্টা বিয়ে কর। তোর বৌ দেহে মরি’।
মাতৃভক্ত দীলিপবাবু সিনেমার নায়কের মত চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘ও মাইজদা তোমরা মাইয়ে দেহ। আমি বিয়ে করবো।’
ব্যাস দীলিপবাবুর বিয়ে হয়ে গেল। রবীন্দ্রসঙ্গীত, বায়েস্কোপ, চাড়ি নিয়ে মেতে থাকা দীলিপবাবু খেয়ালও করলেন না যে, তার সম্মতির পরদিনই তার পাকা দেখা হয়ে গেল। প্রশ্নটা তার মাথাতেই এল না যে, এই রাতের মধ্যে মেয়ে দেখে পছন্দ করা হল কখন। এমনকি বিয়ের সাত বছর পরও সেই মরো মরো মা যখন মরলেন না তখনও দীলিপবাবু ভেতরের নাটকটা ধরতে পারলেন না। আসলে দীলিপবাবুর এসব নাটক ধরার কোন ইচ্ছেও ছিল না। তার নিজের জগতটা ঠিক থাকলেই চলে।
তা আর রইল কই? বিয়ের পরই দীলিপবাবুর জীবনে প্রথম পরিবর্তন এলো, বদলে ফেলা হল তার টেপরেকর্ডার। নতুন বৌ বাপের বাড়ি থেকে স্টেরিও সিডি সেট নিয়ে এসেছে। তার রেকর্ডারের জায়গা হয় না ঘরে। পাটাতনে উঠে গেল দীলিপবাবুর সিঙ্গেল রীড হারমোনিয়াম।
কয়েকমাসের মধ্যেই দীলিপবাবুকে দেখা গেল, ধার দেনা করে কেনা একটা সাইকেলে চেপে সোহরাব সাহেবের পাশে পাশে স্কুলে যেতে। ওই স্কুলে বাংলার মাস্টার হিসেবে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সোহরাব সাহেব।
বদলে গেলেন দীলিপবাবু। আর আগের মত সন্ধ্যা বেলায় গানের আসর বসে না। বায়েস্কোপ চলে না। চাড়িতে ওঠা হয় না। সবই করেন দীলিপবাবু মনে মনে। সকাল-সন্ধ্যা এখন দীলিপবাবুকে ধারের হিসেব করতে হয়। রাত পোহালে কোথায় কোন কিস্তি হিসেব করতে হয়। শুধু দেনা আর দেনা।
দেনাটাও খুব বেশি বড় একটা সমস্যা না। দীলিপবাবুর এইসব দেনাটেনা নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তায় ভোগেন না। এসব তাকে তেমন কাবু করতে পারে না। তারপরও দীলিপবাবু ইদানিং বড় কাবু হয়ে আছেন। কাবু হয়ে আছেন তিনি বৌয়ের ধাতানিতে। রাতদিন, উঠতে-বসতে বৌটা তার মুখ ঝামটা দেয়। কথায় কথায় খ্যাচ করে ওঠে। সারাজীবন অনেক মানুষকে জ্বালাতন করেছেন, কিন্তু এমন ধাতানি এর আগে দীলিপবাবুকে সহ্য করতে হয়নি।
বিয়ের একটা বছর যেতে না যেতেই এই ধাতানির চোটে জীবনের ওপর থেকে দীলিপবাবুর টান উঠে গেল। দোচালা ঘরের বারান্দায় বসে বসে ভাবছিলেনÑকি হবে এই জীবন দিয়ে। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কোনো একটা লাইন মিলিয়ে ভাবছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ফট করে পালিয়ে গেলেন। রান্নাঘর থেকে বৌয়ের গলা শোনা গেল, ‘শোনো চুপ কইরে বইসে থাইয়ে না। স্কুলি যায়ার আগে এট্টু বাজারে যাও। চাইল আনতি হবে। আর মাইয়েডার জন্যি এট্টা কলম আইনো দি। আর আইজ কিন্তু নিতাইগো বাড়ির সমিতিতি কিস্তি আছে।’
দীলিপবাবু এক ছাত্রের খাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে বিড় বিড় করে জবাব দিয়েছিলেন, ‘মনে আছে। সব কইরে ফেরবানে।’
এই জবাব শুনে বৌ আরও চটে গেল। এবার তার গলা মনে হয় এক উঠোন ওপাশে বড়দার ঘর থেকেও শোনা গেল, ‘হ। তুমি কি কইরে ফেরবানে, তা তো আমার জানা আছে। কি তোমার মুরোদ! সারাদিন পইড়ে পইড়ে খাবা আর স্কুলে যাইয়ে ভংচং করবা।’
এই কথার তো কোনো উত্তর হয় না। তাই দীলিপবাবু চুপ মেরে রইলেন। তারপরও বৌয়ের গজগজ কমলো না, ‘একদিন আমি না থাকলি দেখতাম, কি কইরে খাও! ছেলাম আমি আর এহন আছে শহীদ ভাই। এই দু জনের জন্যি দুটো খাচ্ছো।’
শহীদ ভাইয়ের নাম শুনে দীলিপবাবু জ্বলে উঠলেন। ইদানিং শহীদের নাম শুনলেই তার মাথা গরম হয়ে যায়। নিতান্ত ভদ্রলোক বলে কিছু বলতে পারেন না। নতুবা শহীদ যা শুরু করেছেন, তাতে তারে শক্ত একটা মাইর দেওয়াটা নিতান্ত পূন্যের কাজ। এমনকি দীলিপবাবু পারলে শহীদকে খুনও করে ফেলতে পারতেন।
শহীদ আগে দীলিপবাবুর বন্ধু ছিল। বন্ধু ঠিক বলা যায় না; দু জনে একসঙ্গে কলেজ পাশ দিয়েছেন। দীলিপবাবুকে সেই স্কুল জীবন থেকে নানাভাবে অপদস্ত করাতেই শহীদের প্রধান আনন্দ ছিল। এখন তার প্রধান আনন্দ দীলিপবাবুর বৌয়ের ফাইফরমাস খেটে দেওয়ায়।
শুধু ফাইফরমাস খাটা নয়। সংসারে কি হবে, না হবে; কোন জিনিসটা কেনা হবে, বেচা হবে; সবই ঠিক করে এখন শহীদ। দীলিপবাবু চালের বস্তার মতো বারান্দায় পড়ে খাতা দেখেন। আর ঘরের মধ্যে শহীদ আর দীলিপবাবুর বৌ মিলে সংসারের সব ঠিক করে। ঠিক করে কোন সমিতি থেকে আর কতো লোন তুললে একটা ফ্রিজ কেনা যায়!
মাঝে মাঝে দীলিপবাবুর মনে হয়, সংসারটা ঠিক তার না; বোধহয় শহীদের। মাঝে মাঝে মনে হয়, বৌটা ঠিক তার নয়; শহীদের। রোজ এই শহীদের গল্প আর ঠাট্টা শুনতে আর ভালো লাগে না। নিজেরে আসলেই চালের বস্তা মনে হয়।
উঠোনে এসেই শহীদ দীলিপবাবুকে দেখে জোরে হাক দেয়, ‘কিরে চালের বস্তা। বাড়ি আছিস? তোর আর থাহা...’
দীলিপবাবু চিরকালই একটু মোটাসোটা। আগে নিজেকে কখনো চালের বস্তা মনে হত না। শহীদ এখন রোজ তিন-চার বার বলায় মনে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে চালের বস্তা হয়ে বাচতে তো আর ভালো লাগে না। দীলিববাবু একা একা ভাবেন, কি করবেন? খুন করবেন?
সঙ্গীতপ্রেমী দীলিপবাবু খুনের কথা পর্যন্ত ভেবে ফেলছেন!
আজ সকাল বেলায় উঠে শহীদের এই ডাক শুনে দীলিপবাবুর মনে হল, খুন একটা করা দরকার। সবচেয়ে ভালো হত, শহীদকে খুন করে ফেলতে পারলে। কিন্তু সেটা কিভাবে হবে? শহীদের বাবা চেয়ারম্যান। তারে খুন করে দীলিপবাবু পার পাবেন না।
তারপরও রাগের মাথায় একদিন হয়তো খুন করে ফেলতে পারতেন। তার আগেই প্লানটা মাথায় চলে এলোÑখুন করতে হবে বৌকে।
তার বৌয়ের বাবা তো চেয়ারম্যান না। বৌ খুন করলে খুব বড় কোনো ঝামেলা নেই। অবশ্য খুন হিসেবে ধরা পড়লে ফাসি হয়ে যাবে। দীলিপবাবুর আপাতত ফাসিতে ঝোলার একদম ইচ্ছে নেই। আরও বছর কয়েক গান করে যেতে চান দীলিপবাবু। আরেকবার উঠোনে মাইক বাজাতে চান।
অতএব খুনটা হতে হবে একেবারেই খুনের মতো কিছু না। এমন খুন কি করা যায়, যা দেখলে খুন মনে হবে না? এই প্রশ্নটা নিয়েই ইদানিং আছেন দীলিপবাবু। প্রশ্নটা তো সবাইকে করে বেড়ানো যায় না। তাই একা একাই উপায় খুজছিলেন। উপায় হয়ে গেল।
উপায়টা যে হয়ে গেল, তার কৃতিত্ব শহীদের। শহীদের উদ্যোগে বাড়িতে ভিসিআর, কালার টেলিভিশন কেনা হয়েছে। সেই ভিসিআরে দেখার জন্য রোজ বাংলা, হিন্দি, ইংরেজী সিনেমা আনা হয়। ইংরেজী সিনেমাটা শহীদ বা বৌ দেখে না। শুধু ইংরেজী সিনেমাটা টেনে টেনে দেখে; কি যেন খোজে আর হাসে।
শহীদ চলে গেলে, বৌ ঘুমিয়ে পড়লে দীলিপবাবু মাঝে মাঝে ভিসিআরে সিনেমা দেখেন। নিজে মাঝে মাঝে অমিতাভের সিনেমা নিয়ে আসেন, সেগুলো দেখেন। সেদিন অমিতাভের সিনেমা ছিল না। তাই একটা ইংরেজী সিনেমা দেখছিলেন।
এবার বুঝলেন দীলিপবাবু, এই সিনেমায় কি খোজে শহীদরা। তাতে দীলিপবাবুর রাগ হল না। তিনি বরং সিনেমাটার কাহিনীতে মজা পেয়ে গেলেন। অন্য একটা জিনিস আবিস্কার করে ফেললেন; যা খুজছিলেন তিনিÑকিভাবে প্রমান না রেখে খুন করা যায়।
উপায়টা সোজা, একটা রাসায়নিক লাগবে। এটা দীলিপবাবুদের স্কুলের ল্যাবে আছে। নামটা লিখে রাখলেন দীলিপবাবু। এখন কাজটা খুব কঠিন কিছু না। স্রেফ কোনো একটা খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। একটা গাছ দিয়ে তৈরি হয় রাসায়নিক এই গুড়োটা।
জিনিসটা পেটে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত; কিন্তু পোস্টমর্টেমে কিচ্ছু ধরা পড়বে না। হলিউডের পরিচালক যখন সিনেমায় দেখিয়েছে, আর সন্দেহ নেই। ধরা দীলিপবাবু পড়বেন না।
দিন তিনেক লেগে গেল জিনিসটা হাতাতে। এখন একটা সুযোগের অপেক্ষা। সুযোগটাও আসবেই। দীলিপবাবুর বৌয়ের আবার পেটে গোলমাল আছে। রোজ রাতে ইশপগুলের ভুসি খান; ওতে এক ফাকে মিশিয়ে দিতে পারলেই হয়। কখন মেশাবেন, এই হল ঝামেলা।
আজই কাজটা করে ফেলবেন। বুদ্ধি হয়ে গেছে। স্কুলথেকে আর বাজারের আড্ডায় যাবেন না, সোহরাবদার সঙ্গে গল্প হবে না। আগে আগে চলে আসবেন বাড়ি। কেউ টের পাওয়ার আগে রান্নাঘরে গিয়ে ভুসির গ্লাসে জিনিসটা মিশিয়ে দিতে হবে। রান্নাঘরে পেছন দিক দিয়ে ঢোকা জলের মতো কাজ।
সাইকেলটা উঠোনে রেখে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লেন দীলিপবাবু। ঘর থেকে ভিসিআরের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ইংরেজী ছবি চলছে। একটু হাসির শব্দও শোনা যাচ্ছে। গ্লাসটা পেয়ে গেছেন দীলিপবাবু। মাত্র জিনিসটা গ্লাসে মিশিয়ে দিলেন, অমনি কারেন্ট চলে গেল।
একটু চমকে উঠলে দীলিপবাবু। ওরা বেরিয়ে আসবে না তো?
না। ঘরের ভেতর থেকে হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ শহীদের গলা শোনা গেল, ‘একটা গান গাও না বৌদি।’
খিল খিল হাসির আওয়াজ উঠল। আহা, এই হাসি দীলিপবাবু কোনোদিন দেখেননি, শুনেছেন, শহীদের সঙ্গে। একটু আদুরে গলায় বৌ বললো, ‘আমি তো গান ভুলে গেছি।’
‘গান শিখলে কেউ ভোলে নাকি? তুমি গাও।’
বৌ কি গান করতে পারে! এ তো জানতেন না দীলিপবাবু। গ্লাসটা হাতে নিয়ে গানের জন্য অপেক্ষা করছেন। আবার একটু আপত্তি করলো বৌ, আবার জোর করলো শহীদ।
বৌ বললো, ‘দাড়ান। হারিকেনটা জ্বালি।’
শহীদের গলা শোনা গেল, ‘থাক। অন্ধকারেই গান করো।’
একটু সময় সব চুপ। দীলিপবাবুর বৌ গান শুরু করলেনÑআমার সকল দুঃখের প্রদীপ....।
শিউরে উঠলেন দীলিপবাবু, এ যে রবীন্দ্র সঙ্গীত!
বৌ গান জানে; রবীন্দ্রসঙ্গীত জানে! দীলিপবাবুর জগত কেপে উঠল। তার মনে আর খুন নেই, আর নিজেকে চালের বস্তা মনে হচ্ছে না দীলিপবাবুর; বৌ তার রবীন্দ্রসঙ্গীত জানে!
এ কী করছিলেন দীলিপবাবু! একজন শিল্পীকে খুন করছিলেন! আর তার কোনো রাগ নেই। আর কোনো ঘেন্না নেই কারো ওপর। ক্ষমা করে দিয়েছেন দীলিপবাবু। একজন শিল্পী হয়ে আরেকজন শিল্পীর ওপর রাগ রাখতে নেই। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলেন। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল। গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল।
হাতের গ্লাসে কি আছে খেয়াল না করেই ঢক ঢক করে গিলে ফেললেন ইশপ গুলের ভুসি।
শিল্পী মানুষ তোÑএটুকু ভুল হতেই পারে।

শনিবার, ১৬ জুলাই, ২০১১

চোখের জল শুকিয়ে গেছে


১৯৯০ সাল থেকে বিশ্বকাপ দেখি। বুঝে দেখি না, দেখি আর কী।
তখন ভালো ফুটবল, মন্দ ফুটবল; কিচ্ছু বুঝতাম না। হা করে গোল দেখতাম। ফলে আর্জেন্টিনা কি ফুটবল খেলে ফাইনালে উঠেছিল, ফাইনালে কেমন ফুটবল খেলেছিল মনে নেই। শুধু মনে আছে একজন মানুষের কান্না।
খুব কাছে পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ট্রফি ছোয়া হল না বলে একজন মহামানবের কান্নার কথা মনে আছে।
মনে আছে একা একা একটা দলকে ফাইনালে তুলে এনে বিচারকের পক্ষপাতের কাছে সব হারানোর একজন মানুষ হাউ মাউ করে কাঁদছেন। সেই আসলে আমার আর্জেন্টিনা বিষয়ক প্রথম শক্ত কোনো স্মৃতি। আর্জেন্টিনাকে আমি প্রথম ভালো করে চিনেছিলাম সেই মানুষটি, সেই ডিয়েগো ম্যারাডোনার কান্নার ভেতর দিয়ে।
কেন যেন কিছু না বুঝেই সেদিন ওই মানুষটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেদেছিলাম।
তারপর থেকে আর্জেন্টিনার জন্য কান্না অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে। তারপর থেকে সবসময় আমি আর্জেন্টিনার জন্য কাঁদি। আর এই লাতিন দেশটির ফুটবলারগুলোও এমন নিষ্ঠুর, সবাইকে কাদানোতেই যেন ওদের সবচেয়ে বড় শান্তি।
সেদিনের পর থেকে একটিবারও আর্জেন্টিনার হয়ে হাসার সুযোগ করে দেয়নি ওরা। আর্জেন্টিনার সুন্দর ফুটবল দেখে গর্ব করতে পেরেছি, আর্জেন্টিনার গোল উৎসব দেখে আনন্দে নেচে উঠতে পেরেছি, আর্জেন্টাইন কোনো খেলোয়াড়ের জাদু দেখে বুকটা ভরে গেছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাঁদতেই হয়েছে।
এর মধ্যে ১৯৯৩ সালে বাতিস্তুতারা একবার কোপা জিতেছিলেন। বলতে লজ্জা নেই, মফস্বলের ছেলে, তখন কোপা-টোপা বোঝার উপায় ছিল না। তখন ফুটবল মানে বিশ্বকাপ। আর বিশ্বকাপ মানে কান্না। ১৯৯৪ সালে ম্যারাডোনা কাঁদিয়েছেন, ১৯৯৮ সালে ওর্তেগা। ২০০২ সালে আর্জেন্টিনার ‘সর্বকালের সেরা দল’ প্রথম রাউন্ড থেকে মাথা নিচু করে বিদায় নিল; আমরা কাঁদলাম।
২০০৪ সালের কোপায় স্যাভিওলাদের দেখলাম ফাইনালে ব্রাজিলের সঙ্গে সমানে সমান টক্কর দিয়ে ২-২ গোলে ড্র করতে। আবার কাঁদতে হল পেনাল্টি শুটআউটে। দু বছর পর, ২০০৬ বিশ্বকাপে মনটাই ভরে গেল।
জার্মানিতে কী ফুটবলটাই না খেললো আর্জেন্টিনা! রিকেলমে, তেভেজ, রদ্রিগেজ, ক্যাম্বিয়াসো; সঙ্গে পিচ্চি একটা ছেলে লিওনেল মেসি। পুরো বিশ্বকাপটা চরকির মতো নিজেদের পায়ে নাচাচ্ছিল ওরা।
লাভ নেই। সেই কোয়ার্টার ফাইনালে এসে জার্মানির বিপক্ষে আবার কান্না। ২০০৭ সালে ভাবলাম বুঝি কান্নার শেষ হল। এবার কোপাটা অন্তত কেউ নিতে পারবে না। ব্রাজিল খোড়াতে খোড়াতে ফাইনালে উঠল। আর তুঙ্গফর্মের রিকেলমে ও মেসির কাছে ফাইনালের পথে সব দল স্রেফ উড়ে গেল।
ফাইনালে কি হল? ৩-০; ব্রাজিলের পক্ষে রেজাল্ট!
২০১০ বিশ্বকাপের আগে ভেবেছিলাম, এবার আর কান্না-টান্না লাগবে না। কোচ ম্যারাডোনা যেমন লেজে গোবরে করে ফেলেছেন, তাতে দল প্রথম পর্বই পার হতে পারবে না। কিন্তু ওই যে বললাম, ওদের মধ্যে একটা নিষ্ঠুরতা আছে। সেই নিষ্ঠুরতা প্রকাশের আগে কোত্থেকে যেন অমানুষিক একটা সৌন্দর্য এসে ভর করে আর্জেন্টাইনদের ওপর।
সেই সৌন্দর্যের জালে আবার বাধা পড়লাম। মেসি একটাও গোল পেলেন না; কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত বিশ্বকাপের সেরা আকর্ষন হয়ে রইলেন মেসি, সেরা দল আর্জেন্টিনা, সবচেয়ে আকর্ষনীয় কোচ ম্যারাডোনা!
তাদের পরিণতি আর মনে করিয়ে দেব!
আর কাঁদতে ইচ্ছে করে না। এবার কোপায় ভেবেছিলাম একই কথা। যে নোংরা ফুটবল প্রথম দু ম্যাচে খেললো, তাতে এদের জন্য চোখের জল ফেলা যায় না। কিন্তু কষ্ট তো দিতেই হবে। তাই কোস্টারিকার বিপক্ষে জাদু ভর করল। আমরা আর্জেন্টাইনদের নিষ্ঠুরতার কথা ভুলে গিয়ে আবার আশায় বুক বাঁধলাম।
মাঝ রাতে উঠে চোখে জল দিয়ে আবার স্বপ্ন দেখেতে বসলাম। পিছিয়ে পড়ল দুর্দান্ত খেলতে থাকা আর্জেন্টিনা। মেসির পাস থেকে হিগুয়েইন সমতা ফেরালেন। আর গোল হয় না। হিগুয়েইনের আচমকা শট বিস্ময়কর ভাবে ফেরায় উরুগুয়ের কিশোর গোলরক্ষক, মেসি শেষ মুহুর্তে ফিনিশ করতে ভুলে যান, হিগুয়েইনের আরেক শট ফেরে পোস্টের কোনায় লেগে। আমরা ভাবি, এমন ঝড়ো আক্রমনে গোল একসময় আসবেই। আসে না গোল। খেলা চলে যায় সেই পেনাল্টি শুট আউটে। ভয়ে বুক কাপে: ২০০৪, ২০০৬ সালের কথা মনে পড়ে যায়।
তারপরও আবার আশা পাই। মাচেরানো লাল কার্ড দেখায় আর্মব্যান্ড এখন মেসির হাতে। ভাবি, ঈশ্বর এই চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, এক ম্যারাডোনা তোদের কাদিয়ে শেষ করেছিল এক পর্ব। আরেক ম্যারাডোনার হাতে তোদের ভাগ্য দিলাম সপে।
হায় রে ভাগ্য। চার জন আর্জেন্টাইন পেনাল্টি শুটআউটে গোল করলেন। তারপরও কাঁদতে হল। কে কাঁদালেন।
আর্জেন্টিনায় এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার, জিপসি কার্লোস তেভেজ; আমাদের কার্তিলোজ।
কাঁদতেও যেন ভুলে গেছে আর্জেন্টাইনরা।
অভিশাপও দিতে পারি না।
এরা যে সব ফুটবল ঈশ্বরের উত্তরসুরী। ঈশ্বরের সন্তানদের কিভাবে অভিশাপ দেই!

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০১১

আমাদের ধনী খেলোয়াড়রা


সিদ্দিকুর রহমানের বড় শখ, টাইগার উডসের সঙ্গে দেখা করবেন। এবার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বাগড়া না দিলে হয়তো সদ্য শেষ হওয়া ইউএস ওপেনেই সাক্ষাত্ হয়ে যেত। সে না হোক; একটা জায়গায় উডসকে ছুঁয়ে ফেললেন সিদ্দিকুর। বিশ্বাস হচ্ছে না?
টাইগার উডস এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উপার্জনকারী খেলোয়াড়। আর সিদ্দিকুর রহমান এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি উপার্জনকারী খেলোয়াড়। ফলে সিদ্দিকুরকে ‘বাংলাদেশের টাইগার উডস’ তো বলতেই পারেন। অন্তত আয়ের বিবেচনায়।
ছোটবেলায় জানতাম, খেলতে হলে টাকা ব্যয় করতে হয়। ক্লাবের চাঁদা দিতে হয়, ফুটবল কেনার জন্য টাকা দিতে হয়; আরও কত কী! মোট কথা খেলা মানে পকেটের টাকা ব্যয়। আর এখন বুঝতে পারছি, খেলা মানে আয়!
আয় মানে কত টাকা? সে কথা শুনে আর কাজ নেই। টাইগার উডস, কোবি ও’ব্রায়েনরা নাকি বছরে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামাচ্ছেন স্রেফ খেলাধুলা করে! মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বুঝতে পারছেন? বাংলায় টাকা করলে কোটি কোটি টাকা বললেও কুলাবে না।
আচ্ছা, দেশের বাইরে যাওয়ার দরকার কী? আমাদের দেশে ও রকম বিলিয়ন ডলার আয় করে ফেলা খেলোয়াড় এখনও জন্মাননি। তাই বলে একেবারে সবাই খালি হাতে বসে আছেন, এমন ভাবারও কারণ নেই। এ বাংলাদেশেরই বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় এখন বছরে কোটি টাকার ওপর আয় করছেন।
এ পর্যন্ত সব জানা কথা। সবাই মোটামুটি অনুমান করতে পারি, বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা এখন ভালোই আয় করেন। কিন্তু সেটা কত? আর দেশের কোন খেলোয়াড় সবচেয়ে বেশি আয় করেন?
বৈশ্বিকভাবে এ ধরনের যেসব তালিকা তৈরি হয়, তা করে সাধারণত ‘ফোর্বস’ বা ‘ফরচুন’ ধরনের কোনো পত্রিকা। এদের তালিকা দেখে আমরা বুঝতে পারি, এ বছরের শীর্ষ উপার্জনকারী খেলোয়াড় কে? কিন্তু বাংলাদেশে এ রকম কোনো উদ্যোগ তো নেই। তাই নিজেদেরই একটা উদ্যোগ হাতে নিতে হল।
খুব ভুল হয়েছিল কাজটা। উদ্যোগটা হাতে নিয়েই দেখা গেল, নানারকম তথ্য সঙ্কট। প্রায় কোনো ধরনের নিশ্চিত তথ্যই হাতে পাওয়া যায় না। তারপরও কাজটা শেষ করতে হল। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া হিসাবগুলো মিলিয়ে একটা তালিকা দাঁড় করানো হল।
হিসাব দাঁড় করানো শেষ হতে আমরা আবিষ্কার করলাম, বাংলাদেশের শীর্ষ উপার্জনকারী দেশের এক নম্বর গলফার সিদ্দিকুর রহমান। সর্বশেষ বছরে তার মোট আয় ছিল প্রায় সোয়া ৪ কোটি টাকা। ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার সামান্য বেশি নিয়ে বছরে দ্বিতীয় সেরা উপার্জনকারী হলেন বাঁহাতি অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। সিদ্দিকের পর সেরা পাঁচে পরের চারটি নামই চার ক্রিকেটারের। বাকিরা হলেন-মাশরাফি বিন মর্তুজা, তামিম ইকবাল ও মোহাম্মদ আশরাফুল।
তালিকা তো জানলেন। এবার হিসাব পদ্ধতি নিয়ে দু কথা বলা যাক। আয়ের হিসাব করতে গিয়ে প্রধান যে ঝামেলাটা পোহাতে হয়েছে, সেটা দুনিয়ার সব হিসাবকারী প্রতিষ্ঠানকেই পোহাতে হয়-বিজ্ঞাপন ও পৃষ্ঠপোষকের হিসাব। পৃথিবীর কোনো খেলোয়াড়েরই এ হিসাবটি পরিষ্কার করে প্রকাশ করা হয় না।
তবে বাইরের দেশগুলোতে সুবিধা হল, প্রত্যেক খেলোয়াড়ের একজন এজেন্ট থাকেন। যারা হিসাব করতে চায়, তারা লোক লাগিয়ে ওই এজেন্টের অফিস থেকে একটা হিসাব বের করে ফেলে। আমাদের এখানে ও রকম ডেডিকেটেড এজেন্টের কোনো বালাই কারও নেই।
ফলে এ ক্ষেত্রে খানিকটা অনুমান ও খানিকটা সরাসরি বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর সাহায্য নিতে হয়েছে। বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো তাদের নৈতিক কারণেই কোনো খেলোয়াড়ের প্রকৃত আয় প্রকাশ করে না। ফলে আমাদেরও ‘সোর্স’ থেকে পাওয়া আনুমানিক হিসাব দিতে হয়েছে।
খেলে সরাসরি খেলোয়াড়রা যে টাকা পান, এটাও জানাটা এক মুশকিল। গলফার সিদ্দিকুরের ক্ষেত্রে এ সমস্যা ছিল না। তার প্রতিটি টুর্নামেন্টে পাওয়া পুরস্কারের অর্থ পরিষ্কার উল্লেখ করা আছে এশিয়ান টুরের ওয়েবসাইটে। কিন্তু ঝামেলা হল ক্রিকেটারদের আইপিএল ও কাউন্টি চুক্তি নিয়ে।
আইপিএল থেকে সাকিব, মাশরাফি ও আশরাফুল বছরে ঠিক কত টাকা পেয়েছেন, কত টাকা ট্যাক্স হিসেবে কেটে রাখা হয়েছে-ব্যাপারগুলো পরিষ্কার নয়। তারপরও মূল নিলামে যে টাকা বলা হয়েছিল, তার থেকে সাধারণ আয়কর বিয়োগ করে হিসাবটা করা হল।
আরও মুশকিল হল সাকিবের কাউন্টি আয়ের হিসাবটা বের করতে গিয়ে। কাউন্টিতে তো আর নিলাম হয় না, যে এর কোনো ডকুমেন্টস পাওয়া যাবে। কাউন্টি কর্তৃপক্ষ কখনই তাদের সঙ্গে খেলোয়াড়ের চুক্তির অর্থপরিমাণ প্রকাশ করে না। তার ওপর সমস্যা হল, ওখানে টাকা দেওয়া হয় সপ্তাহ হিসাবে। তারপরও ইংল্যান্ডের কিছু সূত্র এবং সাকিবের কিছু ইঙ্গিত কাজে লাগানো হল।
পরের ঝামেলা হল, খেলোয়াড়দের বিসিবি ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে আয়। সংশ্লিষ্ট চার খেলোয়াড়ই এ-প্লাস বেতনভুক্ত ক্রিকেটার। ফলে তাদের বেতন জানাটা খুব কঠিন কাজ ছিল না। চারজনের বেতনই কাছাকাছি। সঙ্গে বছরে ৩০-এর বেশি ম্যাচ খেললে মাসিক বেতন ৫ হাজার টাকা করে বাড়বে এবং অধিনায়ক ও সহঅধিনায়ক কিঞ্চিত বেশি বেতন পান।
এটুকু হিসাব একরকম পরিষ্কার। কিন্তু ঝামেলা হল ম্যাচ ফি, পুরস্কার ও বোনাসের টাকা। ম্যাচ ফি নির্ধারিত, কিন্তু পুরস্কার বোনাস বিভিন্ন সময় ও টুর্নামেন্ট অনুযায়ী বিভিন্ন হয়ে থাকে। ফলে এ হিসাব কোনো খেলোয়াড় নিজে রেখে না থাকলে, কারও কাছে থাকা অসম্ভব। কোনো ক্রিকেটার সেই হিসাব গুছিয়ে রাখবেন এবং কাছে গেলে তালিকাটা বের করে দেবেন; সেটা আশা করা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। এ ব্যাপারে বিসিবির একটি সূত্র, সামান্য সহযোগিতা করে আনুমানিক একটা অঙ্ক দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
এবার আসুন আসল ঝামেলায়-ক্রিকেটারদের লিগ আয়। ক্রিকেটাররা কে কোন দলে কত টাকায় খেলতে নামছেন, এটা মৌসুমের আগে বেশ চাউর হয়ে যায়। ঝামেলা হল, সেই অঙ্কটা মৌসুম শেষে ঠিক থাকে না। অনেক সময় কম, বিরল ক্ষেত্রে বেশি টাকাও দেওয়া হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরাসরি টাকা না দিয়ে বাড়ি-গাড়ি দেওয়ারও নজির রয়েছে। তাহলে আমরা হিসাবটা করব কী দেখে? আমরা সরল পথ নিয়েছি। প্রথমে যে টাকায় ক্রিকেটারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, সেটাই হিসাবে নেওয়া হয়েছে।
এই তো গেল অঙ্কগুলো উদ্ধার করার হ্যাপা। কিন্তু ঝামেলা এখানেই শেষ নয়। তালিকা করতে বসে আরেকটা সমস্যায় পড়া গেল-আমরা কোন বছর ধরে হিসাবটা করব। শুধু ২০১০ সালের অ্যাওয়ের হিসাব করা যেত। কিন্তু তাতে ঝামেলা হল, ক্রিকেট মৌসুম ব্যাপারটা হয়ে থাকে দুই বছর মিলিয়ে; মানে প্রায় অর্থবছরের মতো।
আমরা তাই অর্থবছরকে অনুসরণ করলাম। তাতে একটা সুবিধা পাওয়া গেল, হিসাবটা এ সদ্য শেষ হওয়া জুন মাসের ৩০ তারিখে ‘ক্লোজ’ করা গেল। আবার অসুবিধাও হল। আইপিএল তো অর্থবছরে হয় না। এটা হয় ইংরেজি পঞ্জিকা অনুযায়ী। এবার সমস্যা হল, মাশরাফি-আশরাফুল ২০১০ পর্যন্ত আইপিএলে ছিলেন। তাদের পুরো ওই বছরের আয় কি আমরা হিসাবে নেব?
আবার সাকিব সদ্য শেষ হওয়া আইপিএলে খেলে এসেছেন। তার আয় কি এ হিসাবে ঢুকবে? এ ক্ষেত্রে তিনজনেরই বার্ষিক আয়কে অর্ধেক করে এ হিসাবে যোগ করেছি। ভাগ্যক্রমে, তিনজনের কেউ ২০১০ ও ২০১১ দুই মৌসুমেই আইপিএলে ছিলেন না। তাহলে হিসাবটা আরও জটিল হয়ে যেত।
এতক্ষণে সম্ভবত আমাদের হিসাব প্রক্রিয়াটা খানিকটা বোঝানো গেছে। এবার আমরা একটু শীর্ষ আয়কারীদের আয়টা খতিয়ে দেখি।
প্রথমেই সিদ্দিকুর রহমান। এ বেচারার বাড়তি আয় বলে তেমন কিছু নেই। ২০১০ সালের জুলাই থেকে শুরু করে এ বছরের গত মাসে কুইনস কাপ পর্যন্ত সিদ্দিক বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলে ৫ লাখ ৬ হাজার ৬২২ ডলার আয় করেছেন। বাংলাদেশি টাকায় যার অর্থ দাঁড়ায় প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এটাই সিদ্দিকুরের মূল উপার্জন। সঙ্গে কিছু টাকা আসে তার পৃষ্ঠপোষক সংস্থা গ্রামীণফোন থেকে।
এ সংস্থার সঙ্গে সিদ্দিকুরের চুক্তি দ্বিমুখী। একটা বার্ষিক চুক্তি আছে, সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনের আলাদা প্রাপ্তি। যতদূর জানা গেছে, এ সংস্থা থেকে গড়ে বছরে লাখ তিরিশেক টাকা পেয়ে থাকেন সিদ্দিকুর।
এক নম্বরের ব্যাপারটা সহজ। সমস্যা শুরুই হল দ্বিতীয় স্থান থেকে। বিসিবি সূত্র বলছে, সাকিবের বার্ষিক বেতন ১৭ লাখ টাকার কাছাকাছি। ম্যাচ-ফি ও বোনাস মিলিয়ে গত অর্থবছরের সময় পেয়েছেন প্রায় ৩০ লাখ টাকা। লিগে মোহামেডান থেকে ৩৫ লাখ টাকার কাছাকাছি পেয়েছেন বলে গুঞ্জন। কাউন্টি থেকে গত মৌসুমে সাকিবের আয় ছিল প্রায় ৩৬ লাখ টাকা।
বাকি রইল আইপিএল ও বিজ্ঞাপন। আইপিএল থেকে সাকিব বছরে প্রায় ৩ কোটি টাকা পেয়ে থাকেন। যেহেতু তার আইপিএল অভিযান ২০১১ সালেই শুরু হয়েছে, তাই আমরা এ হিসাবে তার এক বছরের আয়ের অর্ধেককে অন্তর্ভুক্ত করেছি। বাকি রইল বিজ্ঞাপন।
বিজ্ঞাপন থেকে ঠিক কত টাকা গেল বছরে আয় করেছেন সাকিব? এ প্রশ্নের উত্তর কারও কাছেই নেই। খোদ সাকিবের কাছেও এর কোনো নির্দিষ্ট হিসাব নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে বার্ষিক আয় আছে। আছে বিজ্ঞাপনপ্রতি আয়, আছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার আয়।
এসব আয়ের ব্যাপারে ভালো খোঁজখবর রাখেন এ রকম একজন বললেন, ‘সাকিব বড় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পেপসি, টিভিএস, ইউসিবির মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আছে। তামিম ও সাকিব দুজনেরই বিজ্ঞাপন ও এনডোর্সমেন্ট অনুসরণ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, দুজনেরই এ বাবদ বার্ষিক আয় প্রায় ১ কোটি টাকা করে।’
আমরা এ সংখ্যাটি গ্রহণ করে যোগ-বিয়োগ করে দেখেছি সাকিবের গত বছরে মোট আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। প্রায় একই রকম একটি হিসাব করে মাশরাফির আয় দেখা যাচ্ছে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকার কাছাকাছি।
বেতন-টেতন একই রকম ধরা হয়েছে। যদিও ম্যাচ ২০১০-১১ মৌসুমে খুব বেশি খেলেননি। তারপরও ম্যাচ-বোনাস মিলিয়ে মাশরাফির আয়ও ওই ২০ লাখ টাকার কাছাকাছি বলে ধরা হয়েছে। এ মুহূর্তে ইনজুরিতে ঘরে বসে থাকলেও বিজ্ঞাপনদাতারা মুখ ফিরিয়ে নেননি মাশরাফির দিক থেকে। পেপসিসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে বছরে ৭০ লাখ টাকার কাছাকাছি আয় আছে তার।
মাশরাফি আবাহনীতে ইনজুরির জন্য মাত্র গোটা তিনেক ম্যাচ খেললেও ক্লাব থেকে পেয়েছেন প্রায় ২৫ লাখ টাকা। এবার আইপিএলের হিসাব। গত বছর পর্যন্ত কলকাতা নাইট রাইডার্সের সঙ্গে চুক্তিটা ছিল মাশরাফির। সেখান থেকে বছরে তার প্রাপ্তি ছিল ৪ কোটি টাকা। গত জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সে ক্ষেত্রে তার খাতায় ২ কোটি টাকা জমা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
তামিম ইকবালের ক্ষেত্রে এসব আইপিএল-কাউন্টি জটিলতা নেই। তিনি কাউন্টি খেলতে গিয়েছেন এ মৌসুমে। যেটা আমাদের হিসাবকালের সময়ে আসবে না। ফলে তার বেতন, ম্যাচ ফি ও বোনাস, মোহামেডান থেকে পাওয়া প্রায় ৩৫ লাখ টাকা মূল হিসাবে আসছে। সঙ্গে বিজ্ঞাপনবাবদ তার আয় ছিল প্রায় ১ কোটি টাকা।
তালিকায় সর্বশেষ নামটি একটু বিস্ময় জাগানিয়া-মোহাম্মদ আশরাফুল। এখন ফর্মে নেই বলে একটু ‘আউট সাইডার’ বলে মনে হচ্ছে। তারপরও মনে রাখতে হবে আশরাফুলকেও এ তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছে আইপিএল। আইপিএল থেকে আশরাফুলের এ সময়ে আয় ছিল প্রায় ৫৪ লাখ টাকা। এছাড়া লিগ থেকে আয় ছিল লাখ বিশেক।
বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে আশরাফুলের ব্যাপারটা একটু রহস্যময়। তিনি বললেন, তার আপাতত বিজ্ঞাপন থেকে কোনো আয় নেই। কিন্তু সূত্র বলছে, বর্তমানে আলাদা কোনো এনডোর্সমেন্ট আশরাফুলের না থাকলেও ২০১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল। সে হিসাবে ওই ছয় মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকার মতো তার বিজ্ঞাপন থেকে আয় ছিল।
পুরো লেখাটি পড়ে পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা, এ হিসাবগুলো নিরেট কিছু নয়। অনেক অনুমান, গোপন খবর ও সম্ভাবনা এ হিসাবে নেওয়া হয়েছে। যদিও পাঠক সান্ত্বনা পেতে পারেন, বিশ্বব্যাপী এ রকম হিসাব করার ক্ষেত্রে অনুমান-সম্ভাবনা-গোপন খবরকে গণনায় নেওয়া হয়।
আমরাও সে পদ্ধতিতে এগিয়েছি। তবে কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে হিসাবে ত্রুটি-বিচ্যুতি বিশ্বের অন্যসব জায়গার চেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এ হিসাবে বিভিন্ন মহল থেকে পাওয়া প্লট-ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন উপঢৌকনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সেগুলো আবার মূল হিসাবকে প্রভাবিত করতেও পারে।
আসলে এতসব আলোচনার তো কোনো অর্থই হয় না।
আসল ব্যাপার, খেলোয়াড়রা এখন আয় করছেন। একটা সময় ছিল, আমাদের দেশের খেলোয়াড়রা টাকার জন্য ফেডারেশন-বোর্ডের মুখে চেয়ে থাকতেন। আজ কিছুটা হলেও দিন বদলেছে।
আশা করা যাক, এক দিন এ রকম আয় অল্প কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। দেশের অধিকাংশ ক্রীড়াবিদ নানা খাত থেকে এমন অর্থের মুখ দেখবেন।জুন ২০১০ থেকে জুন ২০১১

শীর্ষ পাঁচ খেলোয়াড়ের বার্ষিক আয়
সিদ্দিকুর রহমান
প্রাইজমানি ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা প্রায়
বিজ্ঞাপন ও পৃষ্ঠপোষক ৩০ লাখ টাকা (আনুমানিক)
..................................................................
মোট ৪ কোটি প্রায়

সাকিব আল হাসান
বিসিবি বেতন ১৭ লাখ টাকা প্রায়
ম্যাচ ফি ও অন্যান্য ৩০ লাখ টাকা (আনুমানিক)
বিজ্ঞাপন ও পৃষ্ঠপোষক ১ কোটি টাকা (আনুমানিক)
লিগ ৩৫ লাখ টাকা
কাউন্টি ৩৬ লাখ টাকা প্রায়
আইপিএল ১ কোটি ৫০ লাখ
..................................................................
মোট ৩ কোটি ৬৮ লাখ প্রায়

মাশরাফি বিন মর্তুজা
বিসিবি বেতন ১৭ লাখ টাকা প্রায়
ম্যাচ ফি ও অন্যান্য ২০ লাখ টাকা (আনুমানিক)
বিজ্ঞাপন ও পৃষ্ঠপোষক ৭০ লাখ টাকা (আনুমানিক)
লিগ ২৫ লাখ টাকা
আইপিএল ২ কোটি টাকা প্রায়
(এক মৌসুমের অর্ধেক ধরে)
...................................................................
মোট ৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা (প্রায়)

তামিম ইকবাল
বিসিবি বেতন ১৭ লাখ টাকা প্রায়
ম্যাচ ফি ও অন্যান্য ৩০ লাখ টাকা (আনুমানিক)
বিজ্ঞাপন ও পৃষ্ঠপোষক ১ কোটি টাকা (আনুমানিক)
লিগ ৩৫ লাখ টাকা
...................................................................
মোট ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা প্রায়

মোহাম্মদ আশরাফুল
বিসিবি বেতন ১৭ লাখ টাকা প্রায়
বিজ্ঞাপন ৩০ লাখ টাকা (বর্তমানে নেই)
ম্যাচ ফি ও অন্যান্য ৩০ লাখ টাকা (আনুমানিক)
লিগ ২০ লাখ টাকা
আইপিএল ৫৪ লাখ টাকা
...................................................................
মোট ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা

সোমবার, ১১ জুলাই, ২০১১

ডিয়েগোর প্রত্যাবর্তন


ছিয়াশির আর্জেন্টিনা দলে কি সব ক জন ‘ক্রেজি’ ফুটবলার ছিলেন নাকি!
আজও বাতিস্তার শেষ সময়ের আচরণ দেখে কথাটা মনে হল। আবার সেই লাভেজ্জি এবং একেবারেই আনকোরা এক বিগিলাকে মাঠে নামানোর দুঃসাহস দেখালে ভদ্রলোক।
তবে আপাতত লোকটির ওপর রাগ ঝেড়ে ফেলতে হচ্ছে যে, অবশেষে নিজের একগুয়েমি থেকে সরে এসে হলেও আর্জেন্টিনার এখনকার সম্ভাব্য সেরা একাদশকে মাঠে নামালেন। ছেলেমানুষী না করে হিগুয়েইন, আগুয়েরো, ডি মারিয়া ও গ্যাগোকে সেরা একাদশে খেলালেন।
ফলটা কি হল?
আপাত দৃষ্টিতে আর্জেন্টিনার ৩-০ গোলের জয়।
আসলে এই ম্যাচে আর্জেন্টিনার প্রাপ্তি লিওনেল মেসির খেলা।মেসি-আগুয়েরো-ডি মারিয়া কম্বিনেশনে মারাত্মক বোঝা পড়া। আবারও বলি, সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মেসিকে আর্জেন্টিনার করে পাওয়া।
তর্কস্বাপেক্ষে এটা বলা যায় যে, আর্জেন্টিনার হয়ে ক্যারিয়ারের সেরা ম্যাচটা খেললেন বিশ্বসেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি।
বিশ্বকাপে আমরা নাইজেরিয়া, গ্রিসের বিপক্ষে মেসির কিছু ঝলক দেখেছি। তারপরও সেটা বার্সেলোনার মেসি ছিলেন না। কালও বার্সেলোনার পিক ফর্মের মেসি বলতে যা বোঝায়, তা হয়তো হলেন না।
সোজা হিসাব, সেটা হলেতো গোল পেতেন। কিন্তু যা করলেন, বার্সেলোনাতেও এমন কাণ্ড খুব একটা করেণ না। অন্তত ১৩ থেকে ১৫টি বল বাড়িয়েছেন, যেগুলো থেকে গোল হওয়া সম্ভব ছিল; এর মধ্যে ৩টি গোল হয়েছে।
বাকিগুলো না হওয়ার জন্য কিঞ্চিত দায় হিগুয়েইন ও শেষ পর্যায়ে লাভেজ্জির; কিছুটা ভাগ্যেরও। এসব হিসাব কোনো কাজের কথা নয়।
কথা হল, পুরো ম্যাচকে নিজের পায়ে মাতাতে থাকা এক মেসিকে পাওয়া গেল; যেটা আর্জেন্টাইনরা চায়।
কেন পাওয়া গেল? একটু খেলাটা বিশ্লেষন করে দেখা যাক।
লিওনেল মেসি বার্সেলোনায় যে জায়গায় খেলেন, বাতিস্তা নির্বোধের মতো সেই ফরোয়ার্ড পজিশনেই আর্জেন্টিনায় তাকে খেলাচ্ছিলেন। আরে ভাই, সে ক্ষেত্রেতো মেসিকে বল দেওয়ার জন্য জাভি-ইনিয়েস্তা চাই।
আপনার দলে জাভি-ইনিয়েস্তা কে? দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ক্যাম্বিয়াসো আর বানেগা! ফাউল!!
কাল যেটা হল মেসিকেই নামিয়ে আনা হল প্লে-মেকারের জায়গায়। তার সামনে ঠেলে দেওয়া হল আগুয়েরো ও হিগুয়েইনকে। বাতিস্তা মেসি কি জিনিস এটা বুঝতেই পারেননি; আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, এই লোক স্প্যানিশ লিগের খেলা দেখে কি না!
আরে মেসি তো আগে প্লে-মেকার। বার্সেলোনার পজেশনে খেলাতে সমস্যা হলে তাকে এখানে নামিয়ে নিন। কাল নামানোর সঙ্গে সঙ্গে ফল। প্রতিটা বল মাঝ মাঠে ধরলেন আর ত্রাস তৈরি করে বল বাড়িয়ে দিলেন বক্সে।
এখানেই আগুয়েরো আর হিগুয়েইনের কৃতিত্ব। প্রথম ম্যাচে এরকম নিচে নেমে কয়েকবার বল বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু তেভেজ তা পেলে আর পাসিং করেন না এবং লাভেজ্জির সে বল ধরারই ক্ষমতা নেই।
এখানেই হিগুয়েইন এক পা এগিয়ে গেলেন।গোল করতে পারেননি। কিন্তু এই রিয়াল স্ট্রাইকার প্রতিটি থ্রু-তে জায়গায় ছিলেন। ফলে প্রতিবারই আক্রমন জমেছে।
আর সেরা কাজটা করেছেন আগুয়েরো। মেসি বল দিয়েই সমানে মেসি-আগুয়েরো-হিগুয়েই-ডি মারিয়ার মধ্যে পাসিং করেছেন; তখন মনে হচ্ছিল: বার্সেলোনা। আসলে ওই যোগ্যতাটা থাকা চাই।
গাছ থেকে যোগ্যতা পড়ে না। চারটে আক্রমনভাগের খেলোয়াড়; চারটেই স্প্যানিশ শীর্ষ দলে খেলে। পাসিং এরা করতে পারবে না তো, ইতালির বাতিল লিগের খেলোয়াড়রা করবে এসে!
যাই হোক, অনেক মন্দ কথা বলেছি।
বাতিস্তার জন্য একটুও শুভ কামনা নেই। দল ভালো করুক।
কিন্তু শিরোনামের কি হল?
আগের দিন লিখেছিলাম: ফিরে আসুন ডিয়েগো। আজ লিখলাম: ডিয়েগোর প্রত্যাবর্তন!!
কই?


আপনি দেখেননি! আমি দেখেছি। মাঠে নব্বই মিনিট ধরে আমি ডিয়েগোর ছায়া দেখেছি। আমি নিশ্চিত খেলোয়াড়দের সঙ্গে ফোনালাপ তাদের উজ্জীবিত করেছে।
দ্বিতীয় গোল করার পর আগুয়েরো যেভাবে গিয়ে মেসিকে জড়িয়ে ধরলেন, তাতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম: ডিয়েগো পাশে দাড়িয়ে তৃপ্তির হাসি হাসছেন।
তার মানসপুত্র ও তার জামাতা এভাবে জুটি বাধলে সেখানে ডিয়েগো না থেকে পারেন!!!!

বুধবার, ৬ জুলাই, ২০১১

ফিরে আসুন ডিয়েগো



২০০২ বিশ্বকাপের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
লাতিন আমেরিকা জোনের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন, তখনকার ফিফা এক নম্বর হিসেবে বিশ্বকাপে ‘হটেস্ট ফেবারিট’ হয়ে কোরিয়া-জাপানে এসেছিল আর্জেন্টিনা।
কী সেই দল!
ভেরন, ক্যানিজিয়া, বাতিস্তুতা, ওর্তেগা, আইমার, আয়লা, ক্রেসপো; এদের ভিড়ে সে সময়ের ‘প্রডিজি’ স্যাভিওলার জায়গায় হয়নি ২৩ সদস্যের দলে! তর্কস্বাপেক্ষে আর্জেন্টিনার স্মরণকালের সেরা দল নিয়ে মার্সেলো বিয়েলসা শেষ পর্যন্ত কী করেছিলেন?
ইংল্যান্ডের সঙ্গে হেরে ও সুইডেনের সঙ্গে ড্র করে বিদায় নিয়েছিলেন প্রথম পর্ব থেকে। বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই পর্বতের মুষিক প্রসবের পর থেকে আর্জেন্টিনায় এক স্থায়ী ভিলেনের নাম: মার্সেলো বিয়েলসার।
সার্জিও বাতিস্তার জন্য কষ্ট লাগছে। এই লোকটিরও পরিণতি কি বিয়েলসার মতো হতে যাচ্ছে!
বিয়েলসারে সঙ্গে বাতিস্তার আরেকটি মিল হল দু জনই একটি করে অলিম্পিক সোনা জিতে এনে দিয়েছেন আর্জেন্টিনাকে। এবং অত্যন্ত শোকের ব্যাপার এই যে, বাতিস্তা ওই সোনার পদকটিকেই দেখিয়ে চলেছেন; আর কিচ্ছুটি তার মধ্যে দেখার মতো আছে বলে মনে হল না।
১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার এই সতীর্থ খেলোয়াড় হিসেবে আর্জেন্টিনার সেরা শ দুয়েকের তালিকাতেও থাকার কথা নয়। যুব দল নিয়ে কিছু সাফল্য ও ২০০৮ অলিম্পিক সোনার জোরে হয়ে গেলেন ম্যারাডোনার উত্তরসুরী।
ম্যারাডোনা চলে যাচ্ছেন যাচ্ছেন অবস্থায় স্পেনকে ৪-০ গোলে হারিয়ে বাতিস্তা একটা ধারণা তৈরি করলেন যে, তিনি আসলে অনেক বড় কোচ। কোচ হিসেবে বাতিস্তাকে ‘অনেক বড়’ বলা তো দূরে থাক, সাধারণ বলাই এখন কষ্ট।
যে লোকটি তার দলের সেরা খেলোয়াড় কারা এটা চেনে না, তাকে কোচ ভাবাটা কঠিন। আপনি হিগুয়েইন, ডি মারিয়া, আগুয়েরো, মিলিতো, পাস্তোরে, গ্যাগোকে বাইরে রেখে লাভেজ্জি, বানেগা, বেুড়িয়ে যাওয়া ক্যাম্বিয়াসোদের মাঠে নামাবেন; এটা ফাজলামো ছাড়া আর কিচ্ছু না।
প্রতিভা বস্তুটা আজকের দিনে আর গাছে ধরে না। এখন আর সান্তোসে পৃথিবীর অজ্ঞাতে একজন পেলের বেড়ে ওঠার সুযোগ নেই। এখন সান্তোসের নেইমার, গানসোদেরও সবাই চেনে। লাভেজ্জিরা যদি এমন কিছু খেলোয়াড়রই হতেন, রিয়াল মাদ্রিদে না হোক ম্যানসিচি, সাম্পদোরিয়ায় অন্তত দেখা যেত এসব ‘কূলমার্তন্ড’কে।
তা নয়। বাতিস্তা ভাবলেন উনি জহেরতের খনি আবিস্কার করে ফেলেছেন!
খেলোয়াড় নির্বাচনও এই লোকের প্রধান সমস্যা নয়। সে সমস্যা তো ম্যারাডোনারও ছিল। ম্যারাডোনাও জানেত্তিকে বাদে বিশ্বকাপ দল করেছিলেন। গন্ডগোল করে ভেরনকে একাদশে ঠাই দেননি। ম্যারাডোনা-বাতিস্তা কেউই বড় কোচ নয়।
তারপরও ম্যারাডোনা থাকলে অন্তত এই করুন ফুটবল দেখতে হত না। ম্যারাডোনার নামে খাতিরে এবং লোকটির সম্মান রাখতে যাকেই মাঠে নামানো হত, সে একটু জীবন দিয়ে খেলার চেষ্টা করত। যেটা আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে দেখেছিলাম; হারুক-জিতুক দলটি অন্তত অনুপ্রানিত ছিল।
মেসির আর্ন্তজাতিক ক্যারিয়ারে সম্ভবত একমাত্র ওই দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপেই সে সতস্ফুর্তভাবে খেলেছে। কারণ, নিশ্চয়ই ম্যারাডোনা। বাতিস্তা মেসিকে নিয়ে এতো চাপাবাজি করলেন, অথচ ছেলেটিকে এই দু ম্যাচ দেখে মনে হল, খেলাটা ভুলে বার্সেলোনায় ফেলে এসেছে; এখন খুজে দেখছে কোথায় পাওয়া যায়।
বাতিস্তা মোটিভেটর হিসেবে কতোবড় সর্বনেশে তার প্রমান কার্লোস তেভেজ। তেভেজের ক্যারিয়ারের ৫৯ ম্যাচের মধ্যে অন্তত ৩০টি আর্ন্তজাতিক ম্যাচই দেখেছি। এই অ্যাপাচিকে আমি কোনোদিন এতোটা নিস্প্রভ দেখিনি আকাশী-নীল জার্সি গায়ে। আর্জেন্টিনা ০-৪ গোলে পিছিয়ে তারপরও তেভেজের প্রানান্ত ফুটবল দেখলে মনে হয়েছে, সে একাই ম্যাচ জেতাবে! আর সেই ছেলেটিকে পর্যন্ত বাতিস্তা ‘ম্যারাডোনার চামচা-টামচা’ বলে একেবারে প্রানহীন করে রেখেছে মাঠে।



সে যাকগে আমার বাড়িও আর্জেন্টিনায় না; প্রভুর ইচ্ছায় আর্জেন্টিনায় বিয়েও করিনি। ফলে সর্বনাশ ওদের হলে আমার কিচ্ছু না। বাতিস্তা ভিলেন হলে ফল সেই টের পাবেন। আমা কী?
আসলেই আমার কিচ্ছু না! বলি বটে, কিচ্ছু না; কিন্তু আকাশী-নীল জার্সি গোয়ে এই হারতে হারতে ড্র করা আর নিস্প্রান চলা ফেরা দেখলে বুকের কোথায় যেন একটু যন্ত্রনা করে ওঠে।
কোথায় ম্যারাডোনা? ফিরে আসুন, রক্ষা করুন আর্জেন্টিনাকে। ফিরে আসুন ডিয়েগো।

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites