বাবা ঠিক আমাদের চেনা-জানা জগতের মানুষ ছিলেন না।
আমাদের জগতের মানুষগুলোর মতো স্ত্রী-সন্তান-পরিবার-আত্মীয়স্বজন-অর্থ-ভবিষ্যত নিয়ে বাবা কখনো চিন্তিত ছিলেন না।
বাবা কখনো আমাদের পড়তে বসতে বলেননি। বাবা কখনো আমাদের জন্য হাতে করে একটু খাবার বা খেলনা নিয়ে বাড়ি ফিরতেন না। বাবা কখনো বলতেন না, তোরা তো বখে যাচ্ছিস!
বাবা সরকারী চাকরি করতেন; বেশ বড় চাকরি।
গল্প শুনেছি, বাবা নাকি আমাদের তিন ভাইয়ের নাম জানতেন না। জীবনের বিরল কীর্তি হিসেবে বাড়িতে একবার চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে আমাদের লিখেছিলেন: শিব, নারায়ন আর কার্তিক কেমন আছে? উদ্দেশ্য আমাদের তিন ভাইয়ের খবর নেওয়া।
কিন্তু সত্যিটা হল, আমাদের নাম কোনোকালেই শিব-নারায়ন-কার্তিক ছিল না। ধরেই নেওয়া যায়, বাবা আমাদের নাম মনে রাখতে পারতেন না।
বাবার সঙ্গে ছোটবেলায় আমাদের দেখা-সাক্ষাতই খুব একটা হয়ে উঠতো না। দেবহাটা, কলারোয়া, পাটকেলঘাটা, আশাশুনি....আরও কোথায় কোথায় যেন চাকরি করে বেড়াতেন। ফলে ছোটবেলায় বাবাকে দেখায় খুব একটা হয়ে উঠতো না।
বৃহষ্পতিবার গভীর রাতে বাবা বাড়ি ফিরতেন; শুক্রবার সকালে উঠে আবিস্কার করতাম আমরা। সে আবিস্কারে বিরাট কোনো ফূর্তি ছিল না; কোনো ভয়ও ছিল না। কারণ, বাবা কোনো আমোদ নিয়ে আসতেন না। কারণ, বাবা শাসন করতেন না।
বাবা এসে বাগানে চলে যেতেন। একটা দা আর একটা রেডিও। দা দিয়ে কুট কুট করে সারাটা দিন বাগান পরিস্কার করতেন। পাশে বেজে চলতো বিজ্ঞাপন-তরঙ্গ অথবা ইডেনের ক্রিকেট ম্যাচ।
ক্রিকেটের বড় পাগল ছিলেন। জাগতিক এই একটা ব্যাপারই বাবাকে টানত।
বাবার সঙ্গে আমাদের নিয়মিত দেখা হওয়া শুরু হল অবসরে যাওয়ার ক দিন আগে থেকে। বাগেরহাটে নিজেদের জেলায় পোস্টিং পেয়ে অবসরে গিয়েছিলেন। তখন বাড়ি থেকে অষিপ করতেন।
তখন আমরা একটু বড় হয়েছি। বাবাকে এড়িয়ে চলতাম। বাবা তাতে কিছু মনে করতেন না। কাছে নিয়ে আহলাদ করতে না পারলে কষ্ট পাবেন, এমন মানুষ তো ছিলেন না।
অবসরের পরে সার্বক্ষনিক সঙ্গী হয়ে গেল ওই বাগান, সবজি খেত আর রেডিও। কিসব আজব আজব সবজি চাষ করতেন। কখনো চীনা বাদাম, কখনো তরমুজ, কখনো পেস্তা বাদাম!
মিথ্যাচার না করলে বলতে হয়, বাবার এসব বিচিত্র চাষের ফলন বেশিরভাগ সময়ই হতাশাজনক ছিল। তাতে বাবার উৎসাহের কমতি ছিল না। একটা বাদামের চারার পেছনে দিনটা ব্যায় করে দিতেন। সব উৎসাহ ওই চাষে আর গাভাস্কারের ব্যাটিংয়ে।
আমাদের নিয়ে একদমই উৎসাহ ছিল না। আমি তখন সিগারেট ধরেছি। কে একজন এসে নালিশ করলো, ‘তোমার ছলডা তো বিড়ি খায়।’
আমি ঘরে ঘুমের ভান করে শুয়ে শুনছি; বাবা বললেন, ‘বড় হইছে, এখন তো আর আমি নিষেধ করতে পারি না। আমিও তো নস্যি টানি; ওরা কি নিষেধ করে!’
এই আমার বাবা।
তখন বাবার সঙ্গী আমার চাচাতো ভাইটা: তন্ময়। রাতদিন ওই চাষাবাদ করতে করতে তন্ময়ের সঙ্গে বিচিত্র সব গল্প বলতেন। সুনীল গাভাস্কারের সঙ্গে তার কি কথা হল কিংবা ভিভ রিচার্ডস বাবার কাছে কি জানতে চাইলেন: এসব গল্প তন্ময় হয়ে শুনতো তন্ময়।
আমরা বড় হয়ে গেছি। তখন এসব গল্প শোনার মন কই!
বাবার সঙ্গে দূরত্বটা আরও বেড়ে গেল। আমি ‘মানুষ’ হওয়ার আশায় ঢাকায় চলে এলাম। প্রথম আলোতে চাকরি করছি। হঠাৎ শুনলাম, বাবার ক্যান্সার। বাবাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হল।
নিউরোসার্জন দাদার কল্যানে চিকিৎসা বিষয়ক ব্যয় বা চিন্তা কোনোটাই আমাকে করতে হল না। শুধু রাতে পালা করে তিন ভাই থাকতাম বাবার কাছে; পিজি হাসপাতালে। থাকতে হয় বলে থাকতাম। বাবার সঙ্গে তো খাতির ছিল না।
আমি জানতাম, বাবাও আমার খোজখবর রাখেন না। আমিও রাখি না।
একদিন বাবা আমার দুনিয়াটা কাঁপিয়ে দিলেন। গভীর রাতে ফিরেছি হাসপাতালে। আমাকে দেখে মেজদা চলে গেল দাদার বাসায়। বাবা ঘুম; আমার তাই মনে হয়েছিল।
আমি চুপি চুপি পাশের বেডে ঘুমাতে যাচ্ছি; বাবার কণ্ঠ পেলাম, ‘কাবার্ডের মধ্যে একটা বক্সে পায়েস রাখা আছে। খেয়ে নিও। বড় বৌ (আমার বৌদি) এনেছে।’
আমি বললাম, ‘আপনি খাননি কেন?’
বাবা একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘না। তুমি পায়েসটা ভালো খাও তো। তাই রেখে দিলাম।’
আমার চেনা বাবার জগতটা মিথ্যে হয়ে গেল।
আমি পায়েস ভালো খাই সবাই জানে। আমার মা জানে সবার চেয়ে বেশি। আমার বন্ধুরা জানে, আত্মীয়স্বজন জানে। কিন্তু বাবার তো জানার কথা না। তিনি তো আমার নামই মনে রাখতে পারেন না!
বাবা কি করে জানলেন আমার পায়েস ভালো খাওয়ার কথা?
প্রশ্নটা করা হয়নি। ভেবেছিলাম, একদিন চুপি চুপি জিজ্ঞেস করবো। তার আগে বাবার কাকুতিতে তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হল।
একদিন ভোর রাতে ফোন এলো, বোড়ি যেতে হবে। বুঝলাম, বাবা নেই। শেষ বেলায় নাকি আমার নাম করে ডাকছিলেন।
বাবা আমার নাম জানতেন! বাবা আমার পছন্দ জানতেন!
অথচ আমার বাবাকে জানা হল না। বাবাকে প্রশ্নটা করা হল না।
রহস্যটা রেখে চলে গেলেন বাবা।
[একই বিষয় নিয়ে কাছাকাছি গদ্যে বাবা দিবসে প্রথম আলোয় একটি লেখা লিখেছিলাম। সেই লেখার কোনো কপি আমার কাছে নেই।]
Facebook comments for blogger brought to you by AllBlogTools.com