মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০১১

গান



আজ (১৯ জুলাই) সাহিত্যপত্র নতুনধারায় প্রকাশিত আমার গল্প।


সোহরাব সাহেব স্কুল থেকে ফিরছিলেন। সাইকেলেই স্কুলে যাতায়াত করেন তিনি। ফেরার পথে বাজার থেকে দুই তাড়া লাল শাক আর শস্তায় পেয়ে একভাগ কুচো চিংড়ে কিনে ফেলেছেন।
বাজারটা পার হতেই হঠাৎ দেখা দীলিপবাবুর সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে সোহরাব সাহেব হিসেব করতে চেষ্টা করলেন, আজ সকালে কার মুখ দেখে ঘুম ভেঙেছিল তাঁর। মনে করতে পারলেন না। তবে লোকটা যেই হোক সে কুফা নিঃসন্দেহে। কুফা না হলে এই ভর সন্ধে বেলা মাছ-শাক কিনে ফেরার পথে দীলিপবাবুর সঙ্গে দেখা হবে কেন!
দীলিপবাবু অবশ্য অর্ন্তযামী নন। ফলে সোহরাব সাহেবের মনে মনে এই ভুত দেখার মত অনুভুতি হওয়াটা তিনি বুঝতে পারলেন। তিনি দেখলেন সোহরাব সাহেবের হাসি হাসি আন্তরিকতা ভরা মুখটা। আর শুনলেন, ‘কি দীলিপ, আছ কেমন? কলেজতথে ফিরলে কহনে?’
এমন সদালাপের ব্যাপ্তি বড়ই হওয়ার কথা। দীলিপবাবুও যথারীতি এ কথা, ও কথায় সোহরাব সাহেবের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের পর চলে আসলেন আসল কথায়, ‘তা সোহরাবদা কী বাড়ির পথ ধইরলে নাকি? এহনই বাড়ি যেইয়ে করবানে কী? ওর চেইয়ে আমাগো দিক চল’।
আতকে উঠলেন সোহরাব সাহেব। তাহলে আশঙ্কাই সত্যি হল। একটা অজুহাত দাড় করানোর চেষ্টা করলেন, ‘তা যাতি তো পারতাম। কিন্তু এই যে একভাগ মাছ কিনিছি.. এহনই না ফিরলি তো পইচে যাবেনে।’
‘ওয়া নিয়ে চিন্তা কইরো না। দেহি তোমাগো দিক কেডা যায়, তার হাতে পাঠায়ে দিচ্ছি।’-মুহুর্তে মাছের টোপলা নিয়ে রাস্তার ওধারে উধাও দীলিপবাবু। একটু পরেই একগাল হাসি সমেত হাজির, ‘এই দেহ, কাদের ভাই তোমাগো বাড়ির পরেতথেই ফেরবে। কাদের ভাইর হাতে ধরায়ে দেলাম।’
এমন সমাধানের পর আর কথা চলে না। এরপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য দীলিপবাবু কাদেরকে পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘কাদের ভাই, মাছের টোপলা তুমি বৌদির হাতে তুলে দিয়ে তারপর যাইও।’
ব্যাস। কুচো চিংড়ির ব্যপারটা নিশ্চিত! কিন্তু সোহরাব সাহেবের মাথায় তখন আর কুচো চিংড়ি নেই, আছে শুধু ছাড়া পাওয়ার চিন্তা। নিজের কয়েক শ বারের অভিজ্ঞতায় জানেন রাত গভীর না হওয়া পর্যন্ত দীলিপবাবুর হাত থেকে মুক্তি নেই। হা করে দীলিপবাবুর ভাঙ্গা হারমোনিয়ামের সঙ্গে গাওয়া, ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ’ জাতীয় গান শুনতে হবে। আর মাঝে মাঝে সমঝদারের মত বলতে হবে, ‘এই জায়গাটা তো চমৎকার তুলিছো দীলিপ!’
দীলিপ বাবু একজন শিল্পী; রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। রবীন্দ্রনাথের ওপর তার বিশেষ টান। পারলে রবীন্দ্রনাথের নাটকে অভিনয় করতেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন। তা পারেন না দীলিপবাবু। শুধু গান করেন। রেডিও, টিভিতে না; নিজে নিজেই গান করেন। বন্ধু বান্ধবকে, এলাকার লোকজনকে সে গান শোনান। সবাই যে দীলিপবাবুর গান খুব আগ্রহের সঙ্গে শোনেন তা নয়। বরং বলা চলে বেশিরভাগ লোকই দীলিপবাবুর গানের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে চান।
পালিয়ে বাঁচার ব্যাপারটা দীলিপবাবু একেবারেই বুঝতে পারেন না তা না। তবে, বিষয়টাকে তিনি পাত্তা দেন না। পাত্তা দিলে তাঁর চলে না। কারন তাকে তো গান শোনাতে হবে। তিনি একজন শিল্পী।
দীলিপবাবুর এহেন মরিয়া গান শোনানোর চেষ্টার কাছে তাই এলাকার একটু সমঝদার, অসমঝদারদের পালানোর চেষ্টা একেবারেই জলে যায়। যেমন গেল সোহরাব সাহেবের চেষ্টা। শেষ পর্যন্ত দীলিপবাবু যখন ছাড়লেন, তখন আর সোহরাব সাহেবের চৈতন্য বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। বাড়িতে ফেরার পর কুচো চিংড়ির বদলে যে মুখ ঝামটা জুটবে, সে সম্পর্কেও সোহরাব সাহেবের আর ভাবার শক্তি নেই। কেবল দীলিপবাবুদের বাড়ি থেকে বের হয়ে বললেন, ‘আল্লাহ! এই আপদ শুধু আমার ঘাড়েই ওঠে কেন?’
এ কথাটা অবশ্য সোহরাব সাহেব অন্যায় বললেন। এই আপদ অনেকের ঘাড়েই ওঠে। আসলে অনেকে তো মনে করেন দীলিপবাবুর সঙ্গীতসাধনা যত না গান ভালোবেসে, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ জ্বালানোর জন্য। এ কথার পে যুক্তিও আছে, উদাহরনও আছে।
এই যে সেবার বাড়িতে কোন উপল ছাড়াই তিন দিন, চার রাত ধরে মাইক বাজালেন দীলিপবাবু; এর কারন কী? একমাত্র মানুষকে জ্বালানো ছাড়া আর কোন কারন থাকতে পারে বলে মনে হয় না। অবশ্য দীলিপবাবুর এই কাজের পেছণে অকাট্য একটা যুক্তি ছিল, ‘আসলে সোহরাবদা বুইঝলে, আমার টেপ রেকর্ডারটা তো ভাঙা। সাউন্ড হয় না ঠিক মত। রবীন্দ্রনাথের গানের কথাগুলো বোঝা যায় না। তাই মন ভইরে গান শোনার একটা ব্যবস্থা করলাম।’
এই ব্যবস্থা করতে গিয়ে দীলিপবাবুর সাধের ইন্ডিয়ান হিরো সাইকেলটা বেচে দিতে হল। তারপরও আক্কেলের মাইকের দোকানে তার চল্লিশ টাকা বাকি থেকে গেল। সে চল্লিশ টাকা পাওয়ার আশা অবশ্য আক্কেল ছেড়ে দিয়েছে।
দীলিপবাবুর সব কারবারই যে এমন জনবিরক্তিকর তা না। এলাকার যত ইংলিশ প্যান্টপড়া ছেলে-মেয়েদের কাছে দীলিপবাবু একজন জীবন্ত বিনোদন। একেকবার এদের আনন্দের জন্য একেটা আজব বস্তু তৈরি করে ফেলেন তিনি। একবার কোথা থেকে শিখে এলেন হ্যারিকেন আর রঙ্গীন কাগজ দিয়ে বায়েস্কোপ বানানো।
শীতের সন্ধে বেলা দীলিপবাবুর বানানো সেই বায়েস্কোপ দেখে শুধু ইংলিশ প্যান্টপরা ছেলে-মেয়েরা না, বাড়ির বৌরাও বিরাট আমোদ পেল।
দীলিপবাবু ইতিহাসে সবচেয়ে আলোড়ন তৈরি করলেন চাড়িতে ভেসে। পুরোনো পেপারে এক রাশিয়ান লোকের বড় পাত্রে করে নদী পাড়ি দেওয়ার খবর পড়ে আইডিয়াটা মাথায় এসেছিল তার। হাট থেকে কিনে নিয়ে এলেন বিশাল এক চাড়ি। এই চাড়ি ব্যবহার করা হয় গরু-মোষকে খাবার দেওয়ার কাজে।
মাটির সেই পাত্র এবার খাবারের বদলে ধারন করলো দীলিপবাবুকে। নদী তো আশে পাশে নেই। তাই ভেসে পড়লেন তিনি নিজেদের বড় পুকুরেই। বেশ ভালোই চলছিল। হঠাৎ পাশ ফিরতে গিয়ে, কি কিছুৃ একটা হয়ে উল্টে গেল দীলিপবাবুর সেই বাহন। পুকুর পাড়ে রীতিমত ভীড় জমে গেল দীলিপবাবুর সেই ভাসা দেখতে।
ভীড় জমারই কথা। একে তো চাড়িতে ভাসার মত ঘটনা রোজ রোজ ঘটে না। তারওপর আবার বিএ পাশ এক আধবুড়োর এই আজব চেষ্টা। এলাকায় রীতিমত ইতিহাস!
ভালোই চলছিল এভাবে দীলিপবাবুর। একটু বেশি বয়সে হলেও বিএ পাশ করে দীলিপবাবু বেশ কাটিয়ে দিচ্ছিলেন। বাবা যা রেখে গেছেন তাতে পায়ের ওপর পা রেখে চলে না। কিন্তু ভাইদের প্রশ্রয়ে আর মায়ের ‘ও ছোটো মানুষ কী করবে’ টাইপের কথাবার্তার কারনে দীলিপবাবুর গায়ে এই ইহজাগতিক কোন প্রভাব পড়তে পারছিল না। হঠাৎ সব ভেস্তে গেল। বিয়ে হয়ে গেল দীলিপবাবুর।
বিয়েটা দীলিপবাবুর কাছে ‘হঠাৎ’।
কিন্তু বাড়ির লোকজনের আসলে বেশ আগে থেকে নেওয়া প্রস্তুতির একটা ফসল। বয়স পয়ত্রিশ-ছত্রিশ পার করে ফেলার পরও দীলিপবাবু নিজে বিয়ে নিয়ে একটুও আগ্রহী ছিলেন না। বরং বিয়ের প্রস্তাব এলে নিজের অনাগ্রহ প্রকাশে যা করার সবই করতেন। কিন্তু এবার আর কোন বাধাতে কাজ হল না।
আসলে দীলিপবাবুকে রাজী করাতে তার মাও একটু অভিনয় করে দেখালেন। একদিন রাতে বেশ মরো মরো একটা ভাব করে বললেন, ‘ও দীলিপ, আমার তো আর সময় নেই। তুই এট্টা বিয়ে কর। তোর বৌ দেহে মরি’।
মাতৃভক্ত দীলিপবাবু সিনেমার নায়কের মত চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘ও মাইজদা তোমরা মাইয়ে দেহ। আমি বিয়ে করবো।’
ব্যাস দীলিপবাবুর বিয়ে হয়ে গেল। রবীন্দ্রসঙ্গীত, বায়েস্কোপ, চাড়ি নিয়ে মেতে থাকা দীলিপবাবু খেয়ালও করলেন না যে, তার সম্মতির পরদিনই তার পাকা দেখা হয়ে গেল। প্রশ্নটা তার মাথাতেই এল না যে, এই রাতের মধ্যে মেয়ে দেখে পছন্দ করা হল কখন। এমনকি বিয়ের সাত বছর পরও সেই মরো মরো মা যখন মরলেন না তখনও দীলিপবাবু ভেতরের নাটকটা ধরতে পারলেন না। আসলে দীলিপবাবুর এসব নাটক ধরার কোন ইচ্ছেও ছিল না। তার নিজের জগতটা ঠিক থাকলেই চলে।
তা আর রইল কই? বিয়ের পরই দীলিপবাবুর জীবনে প্রথম পরিবর্তন এলো, বদলে ফেলা হল তার টেপরেকর্ডার। নতুন বৌ বাপের বাড়ি থেকে স্টেরিও সিডি সেট নিয়ে এসেছে। তার রেকর্ডারের জায়গা হয় না ঘরে। পাটাতনে উঠে গেল দীলিপবাবুর সিঙ্গেল রীড হারমোনিয়াম।
কয়েকমাসের মধ্যেই দীলিপবাবুকে দেখা গেল, ধার দেনা করে কেনা একটা সাইকেলে চেপে সোহরাব সাহেবের পাশে পাশে স্কুলে যেতে। ওই স্কুলে বাংলার মাস্টার হিসেবে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সোহরাব সাহেব।
বদলে গেলেন দীলিপবাবু। আর আগের মত সন্ধ্যা বেলায় গানের আসর বসে না। বায়েস্কোপ চলে না। চাড়িতে ওঠা হয় না। সবই করেন দীলিপবাবু মনে মনে। সকাল-সন্ধ্যা এখন দীলিপবাবুকে ধারের হিসেব করতে হয়। রাত পোহালে কোথায় কোন কিস্তি হিসেব করতে হয়। শুধু দেনা আর দেনা।
দেনাটাও খুব বেশি বড় একটা সমস্যা না। দীলিপবাবুর এইসব দেনাটেনা নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তায় ভোগেন না। এসব তাকে তেমন কাবু করতে পারে না। তারপরও দীলিপবাবু ইদানিং বড় কাবু হয়ে আছেন। কাবু হয়ে আছেন তিনি বৌয়ের ধাতানিতে। রাতদিন, উঠতে-বসতে বৌটা তার মুখ ঝামটা দেয়। কথায় কথায় খ্যাচ করে ওঠে। সারাজীবন অনেক মানুষকে জ্বালাতন করেছেন, কিন্তু এমন ধাতানি এর আগে দীলিপবাবুকে সহ্য করতে হয়নি।
বিয়ের একটা বছর যেতে না যেতেই এই ধাতানির চোটে জীবনের ওপর থেকে দীলিপবাবুর টান উঠে গেল। দোচালা ঘরের বারান্দায় বসে বসে ভাবছিলেনÑকি হবে এই জীবন দিয়ে। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কোনো একটা লাইন মিলিয়ে ভাবছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ফট করে পালিয়ে গেলেন। রান্নাঘর থেকে বৌয়ের গলা শোনা গেল, ‘শোনো চুপ কইরে বইসে থাইয়ে না। স্কুলি যায়ার আগে এট্টু বাজারে যাও। চাইল আনতি হবে। আর মাইয়েডার জন্যি এট্টা কলম আইনো দি। আর আইজ কিন্তু নিতাইগো বাড়ির সমিতিতি কিস্তি আছে।’
দীলিপবাবু এক ছাত্রের খাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে বিড় বিড় করে জবাব দিয়েছিলেন, ‘মনে আছে। সব কইরে ফেরবানে।’
এই জবাব শুনে বৌ আরও চটে গেল। এবার তার গলা মনে হয় এক উঠোন ওপাশে বড়দার ঘর থেকেও শোনা গেল, ‘হ। তুমি কি কইরে ফেরবানে, তা তো আমার জানা আছে। কি তোমার মুরোদ! সারাদিন পইড়ে পইড়ে খাবা আর স্কুলে যাইয়ে ভংচং করবা।’
এই কথার তো কোনো উত্তর হয় না। তাই দীলিপবাবু চুপ মেরে রইলেন। তারপরও বৌয়ের গজগজ কমলো না, ‘একদিন আমি না থাকলি দেখতাম, কি কইরে খাও! ছেলাম আমি আর এহন আছে শহীদ ভাই। এই দু জনের জন্যি দুটো খাচ্ছো।’
শহীদ ভাইয়ের নাম শুনে দীলিপবাবু জ্বলে উঠলেন। ইদানিং শহীদের নাম শুনলেই তার মাথা গরম হয়ে যায়। নিতান্ত ভদ্রলোক বলে কিছু বলতে পারেন না। নতুবা শহীদ যা শুরু করেছেন, তাতে তারে শক্ত একটা মাইর দেওয়াটা নিতান্ত পূন্যের কাজ। এমনকি দীলিপবাবু পারলে শহীদকে খুনও করে ফেলতে পারতেন।
শহীদ আগে দীলিপবাবুর বন্ধু ছিল। বন্ধু ঠিক বলা যায় না; দু জনে একসঙ্গে কলেজ পাশ দিয়েছেন। দীলিপবাবুকে সেই স্কুল জীবন থেকে নানাভাবে অপদস্ত করাতেই শহীদের প্রধান আনন্দ ছিল। এখন তার প্রধান আনন্দ দীলিপবাবুর বৌয়ের ফাইফরমাস খেটে দেওয়ায়।
শুধু ফাইফরমাস খাটা নয়। সংসারে কি হবে, না হবে; কোন জিনিসটা কেনা হবে, বেচা হবে; সবই ঠিক করে এখন শহীদ। দীলিপবাবু চালের বস্তার মতো বারান্দায় পড়ে খাতা দেখেন। আর ঘরের মধ্যে শহীদ আর দীলিপবাবুর বৌ মিলে সংসারের সব ঠিক করে। ঠিক করে কোন সমিতি থেকে আর কতো লোন তুললে একটা ফ্রিজ কেনা যায়!
মাঝে মাঝে দীলিপবাবুর মনে হয়, সংসারটা ঠিক তার না; বোধহয় শহীদের। মাঝে মাঝে মনে হয়, বৌটা ঠিক তার নয়; শহীদের। রোজ এই শহীদের গল্প আর ঠাট্টা শুনতে আর ভালো লাগে না। নিজেরে আসলেই চালের বস্তা মনে হয়।
উঠোনে এসেই শহীদ দীলিপবাবুকে দেখে জোরে হাক দেয়, ‘কিরে চালের বস্তা। বাড়ি আছিস? তোর আর থাহা...’
দীলিপবাবু চিরকালই একটু মোটাসোটা। আগে নিজেকে কখনো চালের বস্তা মনে হত না। শহীদ এখন রোজ তিন-চার বার বলায় মনে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে চালের বস্তা হয়ে বাচতে তো আর ভালো লাগে না। দীলিববাবু একা একা ভাবেন, কি করবেন? খুন করবেন?
সঙ্গীতপ্রেমী দীলিপবাবু খুনের কথা পর্যন্ত ভেবে ফেলছেন!
আজ সকাল বেলায় উঠে শহীদের এই ডাক শুনে দীলিপবাবুর মনে হল, খুন একটা করা দরকার। সবচেয়ে ভালো হত, শহীদকে খুন করে ফেলতে পারলে। কিন্তু সেটা কিভাবে হবে? শহীদের বাবা চেয়ারম্যান। তারে খুন করে দীলিপবাবু পার পাবেন না।
তারপরও রাগের মাথায় একদিন হয়তো খুন করে ফেলতে পারতেন। তার আগেই প্লানটা মাথায় চলে এলোÑখুন করতে হবে বৌকে।
তার বৌয়ের বাবা তো চেয়ারম্যান না। বৌ খুন করলে খুব বড় কোনো ঝামেলা নেই। অবশ্য খুন হিসেবে ধরা পড়লে ফাসি হয়ে যাবে। দীলিপবাবুর আপাতত ফাসিতে ঝোলার একদম ইচ্ছে নেই। আরও বছর কয়েক গান করে যেতে চান দীলিপবাবু। আরেকবার উঠোনে মাইক বাজাতে চান।
অতএব খুনটা হতে হবে একেবারেই খুনের মতো কিছু না। এমন খুন কি করা যায়, যা দেখলে খুন মনে হবে না? এই প্রশ্নটা নিয়েই ইদানিং আছেন দীলিপবাবু। প্রশ্নটা তো সবাইকে করে বেড়ানো যায় না। তাই একা একাই উপায় খুজছিলেন। উপায় হয়ে গেল।
উপায়টা যে হয়ে গেল, তার কৃতিত্ব শহীদের। শহীদের উদ্যোগে বাড়িতে ভিসিআর, কালার টেলিভিশন কেনা হয়েছে। সেই ভিসিআরে দেখার জন্য রোজ বাংলা, হিন্দি, ইংরেজী সিনেমা আনা হয়। ইংরেজী সিনেমাটা শহীদ বা বৌ দেখে না। শুধু ইংরেজী সিনেমাটা টেনে টেনে দেখে; কি যেন খোজে আর হাসে।
শহীদ চলে গেলে, বৌ ঘুমিয়ে পড়লে দীলিপবাবু মাঝে মাঝে ভিসিআরে সিনেমা দেখেন। নিজে মাঝে মাঝে অমিতাভের সিনেমা নিয়ে আসেন, সেগুলো দেখেন। সেদিন অমিতাভের সিনেমা ছিল না। তাই একটা ইংরেজী সিনেমা দেখছিলেন।
এবার বুঝলেন দীলিপবাবু, এই সিনেমায় কি খোজে শহীদরা। তাতে দীলিপবাবুর রাগ হল না। তিনি বরং সিনেমাটার কাহিনীতে মজা পেয়ে গেলেন। অন্য একটা জিনিস আবিস্কার করে ফেললেন; যা খুজছিলেন তিনিÑকিভাবে প্রমান না রেখে খুন করা যায়।
উপায়টা সোজা, একটা রাসায়নিক লাগবে। এটা দীলিপবাবুদের স্কুলের ল্যাবে আছে। নামটা লিখে রাখলেন দীলিপবাবু। এখন কাজটা খুব কঠিন কিছু না। স্রেফ কোনো একটা খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। একটা গাছ দিয়ে তৈরি হয় রাসায়নিক এই গুড়োটা।
জিনিসটা পেটে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত; কিন্তু পোস্টমর্টেমে কিচ্ছু ধরা পড়বে না। হলিউডের পরিচালক যখন সিনেমায় দেখিয়েছে, আর সন্দেহ নেই। ধরা দীলিপবাবু পড়বেন না।
দিন তিনেক লেগে গেল জিনিসটা হাতাতে। এখন একটা সুযোগের অপেক্ষা। সুযোগটাও আসবেই। দীলিপবাবুর বৌয়ের আবার পেটে গোলমাল আছে। রোজ রাতে ইশপগুলের ভুসি খান; ওতে এক ফাকে মিশিয়ে দিতে পারলেই হয়। কখন মেশাবেন, এই হল ঝামেলা।
আজই কাজটা করে ফেলবেন। বুদ্ধি হয়ে গেছে। স্কুলথেকে আর বাজারের আড্ডায় যাবেন না, সোহরাবদার সঙ্গে গল্প হবে না। আগে আগে চলে আসবেন বাড়ি। কেউ টের পাওয়ার আগে রান্নাঘরে গিয়ে ভুসির গ্লাসে জিনিসটা মিশিয়ে দিতে হবে। রান্নাঘরে পেছন দিক দিয়ে ঢোকা জলের মতো কাজ।
সাইকেলটা উঠোনে রেখে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লেন দীলিপবাবু। ঘর থেকে ভিসিআরের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ইংরেজী ছবি চলছে। একটু হাসির শব্দও শোনা যাচ্ছে। গ্লাসটা পেয়ে গেছেন দীলিপবাবু। মাত্র জিনিসটা গ্লাসে মিশিয়ে দিলেন, অমনি কারেন্ট চলে গেল।
একটু চমকে উঠলে দীলিপবাবু। ওরা বেরিয়ে আসবে না তো?
না। ঘরের ভেতর থেকে হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ শহীদের গলা শোনা গেল, ‘একটা গান গাও না বৌদি।’
খিল খিল হাসির আওয়াজ উঠল। আহা, এই হাসি দীলিপবাবু কোনোদিন দেখেননি, শুনেছেন, শহীদের সঙ্গে। একটু আদুরে গলায় বৌ বললো, ‘আমি তো গান ভুলে গেছি।’
‘গান শিখলে কেউ ভোলে নাকি? তুমি গাও।’
বৌ কি গান করতে পারে! এ তো জানতেন না দীলিপবাবু। গ্লাসটা হাতে নিয়ে গানের জন্য অপেক্ষা করছেন। আবার একটু আপত্তি করলো বৌ, আবার জোর করলো শহীদ।
বৌ বললো, ‘দাড়ান। হারিকেনটা জ্বালি।’
শহীদের গলা শোনা গেল, ‘থাক। অন্ধকারেই গান করো।’
একটু সময় সব চুপ। দীলিপবাবুর বৌ গান শুরু করলেনÑআমার সকল দুঃখের প্রদীপ....।
শিউরে উঠলেন দীলিপবাবু, এ যে রবীন্দ্র সঙ্গীত!
বৌ গান জানে; রবীন্দ্রসঙ্গীত জানে! দীলিপবাবুর জগত কেপে উঠল। তার মনে আর খুন নেই, আর নিজেকে চালের বস্তা মনে হচ্ছে না দীলিপবাবুর; বৌ তার রবীন্দ্রসঙ্গীত জানে!
এ কী করছিলেন দীলিপবাবু! একজন শিল্পীকে খুন করছিলেন! আর তার কোনো রাগ নেই। আর কোনো ঘেন্না নেই কারো ওপর। ক্ষমা করে দিয়েছেন দীলিপবাবু। একজন শিল্পী হয়ে আরেকজন শিল্পীর ওপর রাগ রাখতে নেই। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলেন। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল। গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল।
হাতের গ্লাসে কি আছে খেয়াল না করেই ঢক ঢক করে গিলে ফেললেন ইশপ গুলের ভুসি।
শিল্পী মানুষ তোÑএটুকু ভুল হতেই পারে।

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites