হাফহাতা শার্ট আর হাফ প্যান্ট পরে ঘরের চালে বসে আছেন করিম মাওলা। খালি খালি বসে নেই, অপো করছেন। একটু বাতাসের জন্য অপো করছেন। বাতাস এলেই উড়াল দেবেন। বেশিন অপো করতে হবে না। বাতাসের মতিগতি করিম মাওলার এখন মুখস্থ হয়ে গেছে। মিনিট খানেকের মধ্যেই একবার না একবার হালকা একটু বাতাস আসবে। তাতেই বেশ উড়ে যেতে পারবেন।
বাতাস এসে গেছে। করিম মাওলা লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। এর মধ্যেই উঠোন থেকে সালেহা বানুর গলা শোনা গেল, ‘এহন আবার কোহানে যাও?’
করিম মাওলার একত্রিশ বছর আগে বিয়ে করা বউ সালেহা বানু। একত্রিশ বছর ধরে এই ভদ্রমহিলার মুখে শুধু প্রশ্নই শুনে যাচ্ছেন তিনি। উত্তর খুব একটা দেন না। চুপচাপ থাকেন। এবার উত্তর না দিলে চলে না। তাই বললেন, ‘বাজারে।’
‘বাজারে যাবা সেডা এট্টু কইয়ে গেলি ভালো হইত না? যাইয়ে তো খালি চা-বিড়ির সব্বনাশ করবা। কিছু কেনা কাটা করা দরকার সেয়া খেয়াল আছে?’
‘কি?’Ñএই বাতাসটা গেল, করিম মাওলার ওড়া হল না।
‘আসার সময় দয়া হলি কয়ডা জিরে আর তরকারী-মরকারী নিয়ে আইসো।’
আবার বাতাস আসছে। আর উত্তর দেওয়ার জন্য দেরী করলেন না মাওলা সাহেব। দু হাত শূন্যে মেলে দিয়ে চাল থেকে ঝাপ দিলেন। একটুও নিচে নামলেন না। বাতাসে ভেসে রইলেন। সাতার কাটার মতো করে দু হাত সামনের দিকে চালাতেই শূন্যে চলা শুরু করলেন। উড়ছেন করিম মাওলা।
করিম মাওলা উড়তে পারেন। অনেক দিন ধরেই উড়তে পারেন। প্রাইমারী স্কুলের চাকরি থেকে যেবার রিটায়ার করলেন, তার পরের বছর শীতকাল থেকেই উড়তে পারেন মাওলা সাহেব। পাখির মতো উড়ে খুব বেশিদূর যেতে পারেন না। হাত-পা ব্যাথা হয়ে আসে। একবার উড়ে মাইল দশেক দূরের মল্লিকের ব্রিজে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় খুব কষ্ট হয়েছিল।
মাওলা সাহেব যে উড়তে পারেন, এ নিয়ে শুরুতে গ্রামে বেশ হইচই হয়েছিল। ছোট চরের মধ্যে গ্রাম। হইচই তো হবেই। কিন্তু এখন আর হইচই হয় না। এখন দেখতে দেখতে সবার অভ্যেস হয়ে গেছে। গ্রামের সবাই মেনে নিয়েছে ব্যাপারটাÑকরিম মাওলা উড়তে পারে।
মানিক সাইকেল চালাতে পারে, কালাম খুব ভালো সাতরাতে পারে, করিম মাওলা উড়তে পারে। করিম মাওলা অবশ্য কোনো ট্রেনিং-ফেনিং নিয়ে উড়তে শেখেননি। হঠাৎ হয়ে গেছে।
একদিন নতুন বানানো প্রাইমারী স্কুলের ছাদে বসে ছিলেন। কেন যেন দু হাত ছড়িয়ে দিয়েই বসেছিলেন। হঠাৎ একটু দমকা বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল তাকে। সেই থেকে শুরু। প্রথম প্রথম কিছু সমস্যা হতো। যেমন, পাজামায় পা জড়িয়ে যাওয়াটা ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা।
স্কুল মাস্টারি শুরুর পর থেকে পাঞ্জাবী-পাজামা পরতেন করিম মাওলা। ওড়ার সময় মাঝে মাঝে পাজামায় পা জড়িয়ে গিয়ে কেলেঙ্কারি হতো। একদিন তো পড়েই গিয়েছিলেন। পড়তে পড়তে সাবুদের মেগনিশ গাছের মাথায় এসে আটকে গিয়েছিলেন। পরে হাচড়ে-পাচড়ে কোনোক্রমে নেমেছেন।
আরেকটা সমস্যা হতো নামার সময়। প্রথমদিকে বুঝতেন না বলে ওড়া শেষ করে নামার সময় পায়ে ব্যাথা পেতেন। পরে বুঝেছেন বিমানের মতো করতে হবে। একবারে ধপ করে না নেমে, একটু দৌড়ে থামতে হবে। নানা অভিজ্ঞতা দিয়ে করিম মাওলা এখন পাকা উড়ালী হয়ে গেছেন।
হ্যা, গ্রামের লোকজন মাওলা সাহেবকে এখন ‘উড়ালী মাওলা’ বলে ডাকে। তবু ভালো, কিছু একটা বলে ডাকে। আগে তো মাওলা সাহেবকে কেউ ডাকতোই না। উড়তে শেখার আগে মাওলা সাহেব এই চরে থেকেও যেন ছিলেন না।
স্কুলে মাস্টারি করতেন, ছাত্ররা তার কথা শুনত না। কথা শুনবে কি? কাশে ছাত্ররা থাকলে তো! মাওলা সাহেব একদিক দিয়ে কাশে ঢুকতেন, আরেক দিক থেকে হুড়মুড় করে কাশ থেকে বেরিয়ে যেত ছেলেপেলেরা। কোনোরকম লুকিয়ে-চুরিয়ে নয়, তার সামনে থেকেই বেরিয়ে যেতে। মাওলা সাহেবও কিছু বলতে পারতেন না।
হেডস্যারকে গিয়ে বললে তিনি উল্টো মাওলা সাহেবের উপর প্তি হয়ে বলতেন, ‘আপনিই তো একটা অপদার্থ। আর কারো কাশ থেকে ছাত্ররা এভাবে চলে যায়? আপনি হচ্ছে ম্যানতা মারা স্যার, আপনার সামনে দিয়ে পারে। এরকম ম্যানতা মারা মাস্টেরের চাকরিই তো থাকার কথা না।’
তা সরকারী চাকরি না হলে হয়তো রিটায়ার করার অনেক আগেই চাকরী চলে যেতো করিম মাওলার। চাকরি থেকেই বা লাভটা কি হয়েছে? শুধু তো হেডস্যার না। কারো কাছেই কোনো মানুষের মধ্যে পড়তেন না মাওলা সাহেব।
কমনরুমে গিয়ে বসলে তিনি যেন উপস্থিতই নেই, এমনভাবে আলোচনা হতো। অন্যান্য স্যাররা কতো গল্প করতেনÑকারো ছেলের অসুখ, কারো ছেলে ভালো রেজাল্ট করেছে, কারো বাতের ব্যাথা। একদিন মাওলা সাহেব বলেছিলেন, তার কোমরে ব্যাথা।
শুনে ঠ্যা ঠ্যা করে হেসে উঠেছিলেন হুজুর স্যার, ‘করিম মাওলার আবার কোমর, তাতে আবার ব্যাথা! ষাড়ের ইয়ে লাগাও মাওলা, ঠিক হয়ে যাবে।’
ষাড়ের ইয়ে খুজতে মাওলা সাহেব আর কোথায় যাবেন? নিজেকেই তো ষাড়ের ইয়ে মনে হতো তার। বাজারে গিয়ে তার বয়সীরা যেখানে আড্ডা দেয়, সেখানে বসলে কেউ কথা বলে না। ছোটরা যেখানে বসে, সেই চায়ের দোকানে গেলেও ঝামেলা।
তারই ছাত্র ছিল রশীদ। সেই রশীদ একদিন বিড়ি ফুকতে ফুকতে মাওলা সাহেবকে শুনিয়ে বলে, ‘এই মাওলা মাস্টের কিন্তু একটা সং। পোলাপাইনের পাশে বইসে সেগো লজ্জা দেয়ার চেষ্টা করে।’
আরে বেটা, লজ্জা দেওয়ার কি আছে! তোর বিড়ি খেতে ইচ্ছে হয়, খা না। কিন্তু এমন কথা মাওলা সাহেব বলতে পারেন না। একটা নেভি সিগারেট ধরিয়ে ধীরে ধীরে বাজার থেকে চলে আসতেন। বিকেল বেলায় কোথায় যাবেন? শেষ দিকে নতুন বানানো স্কুল বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠে তাই একা একা বসে থাকতেন।
বাড়ি ফেরার তো উপায় নেই। ছেলেগুলো কেন যেন দুই চোখে দেখতে পারে না। ছোটটা দেখা হলেই বলে, ‘বাবা বিশটা টাকা দেও’।
আচ্ছা, টাকা কি কাছে থাকে? বেতন তুলে বাড়ি ফিরতে যেটুকু সময় লাগে, বেতনের টাকা তো এরপরই সালেহা বানুর হাতে চলে যায়। সারা মাস মাওলা সাহেবকে কড়ায়-গন্ডায় হিসেব দিয়ে পয়সা নিতে হয়। এর মধ্যে তিনি কি করে ছেলেদের টাকা দেবেন?
তাই ছেলের হাতে পড়ার চেয়ে স্কুলের ছাদে বসে থাকাটা অনেক ভালো। অবশ্য বাড়ি ফিরলে ছেলেদের হাতে পড়ার চেয়ে বড় ভয় ছিল সালেহা বানুর হাতে পড়া। এই ভদ্রমহিলা কেন যেন করিম মাওলাকে বিয়ের পরদিন থেকে জোক বলে মনে করেন।
না, মুখে কখনো মাওলা সাহেবকে ‘জোক’ বলে ডাকেননি। মুখে বলতে হয় না। দেখলেই এমন ভঙ্গি করেন সালেহা খাতুন যে, মাওলা সাহেবের নিজেরই নিজেকে জোক বলে মনে হয়।
এই অনুভূতিটার সঙ্গে মাওলা সাহেবের প্রথম পরিচয় বিয়ের পরদিনই। সালেহা খাতুন তখনও ঘোমটা খুলে লোকেদের সামনে পরিচিত হয়ে ওঠেননি। এর মধ্যেই মাওলা সাহেবকে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমার মুখে এমন বিড়ির গন্ধ কেন?’
সেই থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় কোটি খানেক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন মাওলা সাহেব। এর এক শ ভাগের এক ভাগ প্রশ্নেরও উত্তর জানলে মাওলা সাহেব বিসিএস পাস করে যেতেন বলে বিশ্বাস। এখনও চলছে সেই প্রশ্ন আর প্রশ্ন।
বাড়ি ফিরলেইÑপাজামায় দাগ কিসের? এতোন কই ছিলা? এ মাসে বেতন কম পাইলা কেন?; হাজারটা প্রশ্ন। এই যে মাওলা সাহেব উড়তে শিখেছেন, এদে গ্রাম জুড়ে তার একটু হলেও কদর বেড়েছে। লোকে এখন একটু পাত্তা দেয়। কিন্তু সালেহা খাতুন সেই আগের মতোই।
উড়তে শেখার আগে পরে, আরেক জন লোকের কাছে অবশ্য মাওলা সাহেব একইরকম আছেনÑকালীপদ হালদার। হাইস্কুলের অঙ্কের মাস্টার কালীপদ বাবু। এই দুনিয়ায় একমাত্র লোক যিনি উড়তে শেখার আগেও মাওলা সাহেবকে পাত্তা দিতেন।
এখনও দেন, তবে বাড়তি কোনো গুরুত্ব ওড়ার জন্য দেন না। কালীপদ বাবু বরং মাঝে মাঝে বলেন, ‘এই বয়সে এসব ওড়াউড়ি ভালো না, মাওলা। উড়লে উড়বে ছোট ছেলেপিলেরা। তুমি কেন উড়তে যাও। বুড়ো বয়সে উড়তে গিয়ে হাত-পা ভাঙলে বিপদ।’
মাওলা সাহেব এসব কথায় পাত্তা দেন না। উড়তে পারেন বলেই না আজকাল লোকে তার সঙ্গে ডেকে কথা বলে। এমনকি হেডমাস্টার সাহেব পর্যন্ত মাঝে মাঝে বাড়ি এসে দেখা করেন, ‘তুমি তো আমাদের গর্ব মাওলা। তোমাকে নিয়ে এখন পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে।’
হ্যা, পত্রিকায়, মানে স্থানীয় দৈনিক সর্বাঞ্চলে মাওলা সাহেবকে নিয়ে একা লেখা ছাপা হয়েছেÑউড়ন্ত মানব। পাশের গ্রামের বশির এই পত্রিকায় কাজ করে। সে একটু রঙ-টঙ চড়িয়ে লিখেছে, ‘মাওলা সাহেব ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত সাহসী মানুষ বলে পরিচিত। স্থানীয় মানুষের মঙ্গলের জন্য সর্বদাই তিনি ব্যতিব্যস্ত। সেই মাওলা সাহেব এখন উড়তে শিখে স্থানীয় লোকেদের প্রভূত উপকার করছেন...’।
এটা খানিকটা সত্যি। মাওলা সাহেব উড়তে শেখায় গ্রামের লোকেদের সত্যিই কিছু উপকার হয়েছে। অন্তত গাছ থেকে নারকেল পাড়া বা চালের ওপর থেকে কুমড়ো পেড়ে দেওয়ায় মাওলা সাহেবের জুড়ি নেই।
মাওলা সাহেব উড়তে পারায় সবচেয়ে উপকার হচ্ছে ছেলেপিলের। ইদানীং তারা মাওলা সাহেবের খুবই ন্যাওটা হয়ে গেছে। কারণ মাওলা সাহেব উড়ে যাওয়ার সময় ওদের গাছে বেধে যাওয়া ঘুড়িটা পেড়ে দেন, বরই-আম পেড়ে দেন।
মাওলা সাহেব এখনবাজারে গেলে লোকজন খাতির করে বসায়। দু একদিন পয়সা না দিয়েই চা-বিড়ি খেয়ে আসতে পারেন, অন্য কেউ দিয়ে দেয়। লোকেরা বাইরের মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘এই যে আমাগো উড়ালী মাওলা।’
মাওলা সাহেবের খ্যাতি একটু একটু করে শহরে পৌছে গেল। এক টেলিভিশন সাংবাদিক চলে এলেন ক্যামেরা নিয়ে। মাওলা সাহেব ঠিকই উড়লেন। কিন্তু বেয়াড়া ক্যামেরা সেদিন বিগড়ে গেল। তাই টেলিভিশনে দেখা গেল না উড়ালী মাওলাকে।
সবমিলিয়ে মাওলা সাহেবের এখন রমরমা সময়। পুরো গ্রামেরই আজকাল রমরমা সময় যাচ্ছে। সেটা মাওলা সাহেবের জন্য না। গ্রামে বিদ্যুত আসছে বলে। এবার ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে চেয়ারম্যান হয়েছে এই গ্রামের রশীদউদ্দি।
রশীদউদ্দি মাওলা সাহেবেরই ছাত্র ছিল। অত্যন্ত বাঁদর ও মূর্খ প্রকৃতির ছাত্র ছিল। কিন্তু চেয়ারম্যান হয়ে গেলে বাঁদররাও ভালো হয়ে যায়, মূর্খরাও জ্ঞানী হয়ে যায়। তাই রশীদউদ্দি এখন বিশিষ্ট মানুষ। সেই বিশিষ্ট মানুষ রশীদউদ্দির চেষ্টায় গ্রামে বিদ্যুত আসছে।
সে জন্য অবশ্য গ্রামের লোকেদের কিছু টাকা খসাতে হয়েছে। মাওলা সাহেবের বাড়িও লাইন নেওয়ার জন্য ৫ হাজার টাকা দেওয়া লেগেছে। তারপরও বিদ্যুত আসছে। গ্রামে খুটি বসানো শুরু হয়ে গেছে। আগামীকাল থেকে নাকি তারও টানা শুরু হবে।
মাওলা সাহেবেরও এই সুবাদে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের লোকজনের খুব সাহায্য করছেন মাওলা সাহেব। এ খুটি থেকে ও খুটি উড়ে গিয়ে তার টানায় সাহায্য করছেন। কখনো আবার খুটির মাথায় সাদা সাদা সকেট উঠিয়ে দিচ্ছে।
মাঝে মাঝেই হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে, ‘উড়ালী চাচা, এই খুটিতে ক্যাবেলটা একটু লাগায়ে দেন না।’
উড়ালী মাওলা মহা আনন্দে উড়ে উড়ে এইসব করে চলেছেন। জীবনে এই প্রথম নিজেকে বড় প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে।
দেখতে দেখতে গ্রামের সব বাড়িতে তার লেগে গেল। আগামী শুক্কুরবার বাদ জুম্মা রশীদউদ্দি চেয়ারম্যান সুইচ টিপে গ্রামে বিদুত উদ্বোধন করবে। সে নিয়েও বিরাট তোড়জোড়।
স্কুল মাঠে বিশাল প্যান্ডেল করা হয়েছে। মাওলা সাহেব উড়ে উড়ে নারকেলের পাতা, কুটো এনে দিচ্ছেন; লোকেদের বসার জন্য। বিকেল বেলায় শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠান। সারা গ্রাম ভেঙে পড়েছে বিদুত উদ্বোধন দেখার জন্য।
একটা বড় সুইচ টিপে দেবেন চেয়ারম্যান রশীদউদ্দি। সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বলে উঠবে, বেজে উঠবে মাইক। তাই হল রশীদউদ্দি সুইচ টিপলেন। আলো জ্বললো। কিন্তু ঝামেলা করল মাইক। একটা হিন্দী গানের এক লাইন বেজেই কো কো করে থেমে গেল।
এরপর মাইকে গান বাজাতে গেলেই ওই কো কো শব্দ। বড়ই হতাশ হলো লোকজন। তাই বলে অনুষ্ঠান তো থেমে থাকতে পারে না। বক্তুতা শুরু হল। উথালিপাথালি বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন রশীদউদ্দি। হঠাৎ বক্তৃতার মাঝেই তার মনে পড়ে গেল মাওলা সাহেবের কথা, ‘আমাদের গ্রামের গর্ব, এই দুনিয়ার বিস্ময় মাওলা সাহেব সম্প্রতি আকাশে ওড়ার গৌরব অর্জন করেছেন...’
মাওলা সাহেবের বুকটা ফুলে গেল। গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে সালেহা খাতুনও বসা আছেন। তিনি কি শুনছেন কথাগুলো? কে জানে! চেয়ারম্যান বলেই যাচ্ছেন, ‘আমি সরকারের কাছে সুপারিশ করব মাওলা সাহেবকে যেন একুশে পদক দেওয়া হয়...’।
কে যেন ‘হাতেক তালি’ বলে চিৎকার দিল। অমনি হাতে তালি শুরু হয়ে গেল। আবার মাইক কো কো শুরু করল। বড়ই বিরক্ত হচ্ছে চেয়ারম্যান রশীদউদ্দি। বিরক্তি থেকে বাচতেই কিনা প্রস্তাব করলেন, ‘এবার আমাদের একটু উড়ে দেখাবেন উড়ালী মাওলা সাহেব।’
মাওলা সাহেবকে কয়েকজন ধরে নিয়ে গেল স্কুলের ছাদে। কিন্তু মাওলা সাহেব আজ উড়তে চাচ্ছিলেন না। একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। আজ অনুষ্ঠান উপলে বিকেল বেলায় পাজামা-পাঞ্জাবী পরে বেরিয়েছিলেন মাওলা সাহেব। যদি কেলেঙ্কারী হয়ে যায়?
লোকজন কথা শুনল না। মাওলা সাহেব দু হাত ছড়িয়ে বাতাসের জন্য এক লহমা অপো করলেন। তারপরও উড়াল দিলেন। ওপর থেকে সবাইকে কত্ত ছোট্ট দেখা যায়। তার স্ত্রী সালেহা খাতুন, হেডস্যার, রশীদউদ্দি; সব্বাইকে এখন খুব ছোট লাগছে।
মাওলা সাহেব নামার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। তখনই কেলেঙ্কারিটা হয়ে গেল। পা জড়িয়ে গেল পাজামায়। পড়ে যাচ্ছেন মাওলা সাহেব। এখানে গাছও নেই যে আকড়ে ধরবেন। পড়তে পড়তে হঠাৎ হাতের কাছে পেলে সেই তার, আকড়ে ধরলেন মাওলা সাহেব।
গতকাল পর্যন্ত যে তার বরফ ঠান্ডা ছিল, তাই আজ কেমন হিংস্র হয়ে উঠেছে। সালেহা খাতুনের চেয়েও ভয়াবহ চেহারায় জ্বলে উঠল বিদ্যুতের তার।
নিচে ‘গেল গেল’ রব উঠল। রবটা কি শুনতে পেলেন মাওলা সাহেব? নইলে তার থেকে ছিটকে পড়ার সময় তার মুখে অমন হাসি থাকবে কেন?
হাসি হাসি মুখ নিয়ে মাটিতে পড়লেন মাওলা সাহেব। সারা শরীর পুড়ে গেছে, কিন্তু মুখে হাসি। মনে হয়, উড়তে গিয়ে বিদ্যুতে পুড়ে মরার চেয়ে আনন্দের আর কিছু হয় না।
বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১১
উড়ালী মাওলা
বৃহস্পতিবার, জুন ২৩, ২০১১
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
Facebook comments for blogger brought to you by AllBlogTools.com