শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০১১

বিতর্কহীন ২৪ বছর




দাঁড়িয়ে, বসে বা চলন্ত অবস্থায়; যে যেখানে এ লেখাটা পড়ছেন একবার ‘ধন্যবাদ’ শব্দটি উচ্চারণ করুন। ধন্যবাদ দিন আর্জেন্টাইন একজন মা, সেলিয়া মারিয়া কুচিত্তিনিকে। একটা ধন্যবাদ এ মায়ের প্রাপ্য।
আজ ঠিক ঠিক চব্বিশ বছর আগে তখনকার এ পরিচ্ছন্নতাকর্মী ভদ্রমহিলা জš§ দিয়েছিলেন ফুটফুটে এক সন্তানকে। কালক্রমে সেই সন্তান আজ দুনিয়া কাঁপানো ফুটবলার লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। এমন সন্তানকে জš§ দেওয়ার জন্য একটা ধন্যবাদ সেলিয়া মারিয়া কুচিত্তিনি পেতেই পারেন।
সর্বশেষ দুবারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার, সর্বশেষ টানা তিনবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা, সর্বশেষ তিন বছরের মধ্যে দুবছরের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেরা দলের সেরা খেলোয়াড়, সর্বশেষ তিনটি স্প্যানিশ লিগজয়ী দলের প্রাণভোমরা-এ সামান্য কয়েকটা তথ্যই যথেষ্ট। এতেই বোঝা সম্ভব, এ মুহূর্তে এই পৃথিবীর সেরা ফুটবলারটি কে!
আজ থেকে ঠিক ২৪ বছর আগে রোজারিওর সেন্তা ফেতে অত্যন্ত দরিদ্র এক পরিবারে জš§ নিয়েছিলেন লিওনেল মেসি। ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত বাবা হোর্হে হোরাসিও মেসি ছিলেন একটা স্টিল কারখানার কর্মী। আর মা সংসার চালাতে কাজ করতেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে। এমন নুন আনতে পান্তা ফুরোয় পরিবারের চতুর্থ সন্তান হিসেবে ঘিঞ্জি এক আবাসস্থলে দুনিয়ার আলোয় চোখ মেলেছিলেন আজকের বিলিওনেয়ার মেসি!
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বন্দরনগরীর আর সব শিশুর সঙ্গে মিলে ফুটবল খেলতে শুরু করেছিলেন। বাবা হোর্হে কাজের ফাঁকে ফাঁকে গ্রান্দোলি নামে একটা পাড়ার ক্লাব দলে কোচিং করাতেন। বাবার হাত ধরে ওই বছর পাঁচেক বয়সেই গ্রান্দোলির হয়ে খেলা শুরু করলেন। তখনই ছেলেটার বল নিয়ন্ত্রণ আর ড্রিবলিং ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় ফুটবলাররা।
আট বছর বয়সেই ক্ষুদে এ ফুটবল যাদুকরের কাণ্ডকীর্তি দেখে তাকে দলে ভিড়িয়ে ফেলল রোসারিওরই ক্লাব নিউয়েল ওল্ড বয়েস। এখানেই রাতারাতি আর্জেন্টাইন ফুটবলের আলোচনায় চলে আসতে শুরু করলেন। ওই বয়সী মেসির খেলা দেখেই আর্জেন্টাইন পত্রপত্রিকায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিল। ততদিনে মেসির ওপর বিভিন্ন ইউরোপিয়ান ক্লাবের চোখও পড়ে গেছে। এমন অবস্থায় দারুণ সুখের একটা ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হোর্হে মেসির কোনো বাধা ছিল না।
কিন্তু বজ্রপাতের মতোই খবরটা এল মেসি পরিবারে-দুরারোগ্য এক হরমোন রোগে আক্রান্ত মেসি। যে রোগের চিকিৎসায় দীর্ঘকাল ধরে বহুমূল্য ওষুধ, ইনজেকশন চালিয়ে যেতে হবে। এ সামর্থ্য তো মেসি পরিবারের নেই। হোর্হে মেসির কাছে তখন ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলো থেকে একটার পর একটা প্রস্তাব আসছে। আর যে স্কাউটই আসছে, তাকে হোর্হে মেসি বলছেন, ‘ছেলের চিকিৎসার কী হবে?’
বার্সেলোনার স্কাউটরা বললেন, ক্লাব ডিরেক্টরের ছেলেটাকে দেখে পছন্দ হলে চিকিৎসার একটা ব্যবস্থা হতে পারে। ট্রায়াল দিতে মেসিকে নিয়ে আসা হল স্পেনে। এবার আরেকটা ধন্যবাদ দিন কার্লেস রেক্সাসকে। রেক্সাস তখন বার্সেলোনার ক্রীড়া পরিচালক। অত্যন্ত বিরক্তিভরে আর্জেন্টিনা থেকে উড়িয়ে আনা বাচ্চাটির অনুশীলন দেখতে গিয়েছিলেন। দেখেই চমকে উঠলেন। এ কী!
মেসির সামান্য কয়েক মিনিটের কারিকুরি দেখে রেক্সাস এতটাই মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, উঠে গিয়ে কাগজ আনার বিলম্ব সহ্য হয়নি। পকেটে ছিল টিস্যু পেপার। তাতেই মেসিকে দিয়ে তার জীবনের প্রথম চুক্তিপত্রটা সই করিয়ে ফেললেন রেক্সাস। ভাগ্যিস করিয়েছিলেন; তাই আমরা বার্সেলোনার হয়ে অতিমানবীয় ফুটবল খেলতে থাকা ভিনগ্রহের এক ফুটবলারকে উপহার পেলাম।
মেসি বার্সেলোনায় এসে কী কী করেছেন, তার খতিয়ান দিতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। সে কাজে দরকারও নেই। মেসি কত গোল করেছেন, কত গোল করিয়েছেন; এসব কাগুজে হিসাব তাকে পরিসংখ্যানের বিবেচনায় হয়তো সেরা করে তুলবে। কিন্তু এ কাঠখোট্টা পরিসংখ্যানের সাধ্য কি মেসির পায়ের যাদু বর্ণনা করে!
একসঙ্গে ছয় ডিফেন্ডার ঘিরে ধরে তাকে, ভেতর থেকে কী এক অবিশ্বাস্য যাদুবলে বল পায়ে বেরিয়ে আসেন মেসি, আঁকা-বাঁকা ছুটে মোহনীয় ভঙ্গিতে পেছনে ফেলে দেন হতভম্ব ডিফেন্ডারদের, চুলচেরা পাসে পেয়ে যান সতীর্থকে কিংবা বুলেটের মতো আচমকা শটে বল জড়িয়ে যায় জালে। সংখ্যা, গোল, পরিসংখ্যান দিয়ে এ মেসির শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সে শুধু যে দেখে, সেই জানে!
তারপরও বলি, এসব কথা দিয়েও আসল মেসিকে বোঝা যায় না। আসল মেসিকে বুঝতে গেলে একটা শব্দ মাথায় রাখুন-নিষ্কলঙ্ক! এই যে কাতারে কাতারে সাফল্য, গণ্ডায় গণ্ডায় ট্রফি, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার; এর কোনো কিছুই মেসির জীবনে একটা কালির দাগ লাগতে দেয়নি।
মেসির সমবয়সী বা তার আগের প্রজšে§র ফুটবলারদের কথা স্মরণ করে দেখুন। পকেটে দুটি ডলার আর হাতে একটি ট্রফি উঠতে না উঠতেই নারী, মদ, জুয়া, নাইটক্লাব, কোচের সঙ্গে হাতাহাতি; একেকজন মহারথী কী না করেছেন! অথচ এ যেন ফুটবলের শচীন টেন্ডুলকার। সব পাবেন, কিন্তু কাদা লাগতে দেবেন না গায়ে।
লোকে বলে ‘নতুন ম্যারাডোনা’। সাফল্যে হয়তো এখনও ম্যারাডোনাকে স্পর্শ করতে পারেননি। কিন্তু এই যে নিষ্কলঙ্ক এক জীবনযাপন করছেন, তাতে কি ম্যারাডোনাকেও একটু টপকে যাচ্ছেন না!

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites