আমাদের একটা ট্রেন ছিল। অনেক দিন আগেই সে মারা গেছে; মেরে ফেলা হয়েছে!
এই সেদিন পত্রিকান্তরে জানা গেল, শেষকৃত্য হয়ে গেছে আমাদের সেই ছোট্ট, শান্ত ট্রেনলাইনটার। হবে না কেন? আর কত কাল এই বোঝা বইবে সরকার? শেষ পর্যন্ত নিলামটিলাম করে কাদের যেন দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, রূপসা-বাগেরহাট রেললাইনটা খুঁচিয়ে তুলে ফেলার। দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপ।
ট্রেনলাইন তুলে ফেলার দৃশ্য দেখতে নাকি হাজার হাজার মানুষ জড় হয়েছিল। তারা নাকি আহাজারি করেছে; নেতাদের গালি দিয়েছে। কেউ কেউ পুরোনো দিনের কথা মনে করে চোখের জলও ফেলেছে।
আমাদের এই ডিজিটাল দুনিয়ায় বসে একটা ট্রেনলাইনের মৃত্যুতে চোখের জল ফেলাকে ন্যাকামো মনে হতে পারে। এই জল আবেগাক্রান্ত মানুষের বাড়াবাড়ি ভাবাটাও দোষের নয়। কিন্তু এই ব্যাপারটা ঠিক যুক্তি দিয়ে, কাগুজে কথা দিয়ে বোঝানো যাবে না। সেই ১৯১৮ সালে ‘মেসার্স অম্বলাল অ্যান্ড হিমাতলাল’ নামের প্রতিষ্ঠানটি যে বাষ্পশকট এখানে বসিয়েছিলেন, তার সঙ্গে কীভাবে হাজার হাজার মানুষের আত্মা জড়িয়ে গেল, সেটা যুক্তি দিয়ে বোঝানো কঠিন। নদীপ্রধান এলাকা বাগেরহাট, খুলনার মাঝখানে এই যন্ত্রদানব একেবারে বাড়ির পোষা হাতিটা হয়ে উঠেছিল মানুষের কাছে।
আমাদের ছোটবেলায় মামাবাড়ি যাওয়ার মাধ্যম ছিল এই ট্রেন। তখনো কাটাখালী হয়ে বাগেরহাট-রূপসা মহাসড়কের জন্ম হয়নি। মামারা আমাদের নিতে আসতেন। ভোররাতে উঠে নাক, চোখ মুছতে মুছতে রওনা হতাম ট্রেনের উদ্দেশে। কয়েক ঘণ্টা দেরি করে একসময় ছেড়ে দিত ট্রেন। বগিতে চাপা একটা গন্ধ, লেবু-আঙ্গুর বিক্রেতার হাঁকাহাঁকি। আমাদের বুকে আগুন জ্বালিয়ে একটু বড়রা চলন্ত ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতেন। দোলায় দোলায় ঘুম পেয়ে যেত। এর মাঝে আবার সিঙ্গাতি বলে একটা স্টেশনে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকত ট্রেন। ওপাশ থেকে আরেকটা ট্রেন আসছে, তাকে জায়গা করে দিতে হবে। আমরা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শুনতাম ‘কু-উ-উ...’।
পাশ থেকে মা মাথাটা টেনে নিয়ে কোলে চেপে ধরে বলতেন, ‘বাইরে মাথা দিস না..।’ এই সব সম্পর্কের কথা কি যুক্তি দিয়ে বোঝানো যাবে?
তবে চূড়ান্ত কথা হলো, আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না। ট্রেনের মতো একটা ব্যয়বহুল ব্যাপার লাভছাড়া টিকিয়ে রাখবে রাষ্ট্র: এটা ভাবা তো অন্যায়। আর এখানে বলা হচ্ছিল, রূপসা-বাগেরহাট রেল নাকি লোকসানই করে যাচ্ছে। ১৯৯৭ সালে অনেক আপত্তি, স্কুল-কলেজের স্বপ্নবাজ ছেলেদের বাধা অতিক্রম করে ট্রেনটা যখন বন্ধ করে দেওয়া হয়, বলা হয়েছিল, ৫০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে, এখানে ট্রেন চালাতে গিয়ে। বাগেরহাট-রূপসার ট্রেন আমাদের কাছে স্মৃতিকাতরতার ব্যাপার হতে পারে, প্রয়োজনীয় একটা বাহন হতে পারে; তাতে রাষ্ট্রের কী? রেলওয়ের কী? তারা কেন গাঁটের পয়সা খরচ করে হাতি পুষবে! তাদের যুক্তি তো ঠিকই ছিল।
আসলেই কি তাই? আমাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু তা বলে না। বলা হচ্ছিল, বাগেরহাট-খুলনার ফাঁকিবাজ লোকেরা টিকিট না কেটে কেটে রেলওয়ের বারোটা বাজাচ্ছে। আসল চিত্র অন্য রকম ছিল বলেই জানতাম আমরা। ১৯৯০ সালে একবার এরশাদ সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী মহোদয়ও জোর উদ্যোগী হয়েছিলেন এই রেললাইনটা বন্ধ করে দিতে। তিনিও তোতাপাখির মতো এসব লোকসানের যুক্তি দিলে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাগেরহাটের বাসিন্দারা। রেল রার জন্য তখন অ্যাডভোকেট সামসুল হককে প্রধান করে একটা কমিটি করা হয়েছিল। সে কমিটি যা যা করেছে, তার ফিরিস্তি দিতে চাই না। অন্তত তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রীকে বাগেরহাটে যে ‘অভ্যর্থনা’ স্থানীয় লোকজন দিয়েছিল, সে ফিরিস্তি দেওয়া তো একেবারেই অন্যায়।
কিন্তু এই কমিটি একটা যুগান্তকারী কাজ করে ফেলেছিল তখন। ‘রেলে লোকসান’ শুনে শুনে কান পচে যাওয়ার জোগাড় হওয়ায়, তারা বাগেরহাটের পিসি কলেজের ছাত্রদের দিয়ে রেলের আয় পর্যবেণের জন্য একটা দল করে দিয়েছিল। সেই দলটি চারভাগে বিভক্ত হয়ে মাত্র চারটি স্টেশনে একটানা সাত দিন টিকিট বিক্রি তদারকি করেছিল। তাতে রেল কর্তৃপ ঠিক কত টাকা আয়ের মুখ দেখেছিল, তা পরিষ্কার না করলেও, প্রকাশ্যে তারা স্বীকৃতি দিয়েছিল, এই সাত দিন লাভে চলেছে রূপসা-বাগেরহাট রেল!
গোটাদশেক স্টেশনের মাত্র চারটিতে টিকিট বিক্রি তদারকি করে (তা-ও আবার ছাত্র ও দরিদ্রদের ছাড় হিসাব করেই) যদি সাত দিন রেলওয়ে লাভে চলে, তা হলে সারা বছর লোকসান করে কেন? ওই তদারকির অভাব? নাকি ভূত আরও ভেতরে?
কে জানে! এত দিন পরে আর এসব প্রশ্ন কাকে করা! আফসোস করে বোধহয় লাভ নেই। কারণ, আমাদের এখানে এটাই নিয়ম। সারা দুনিয়া চলে একদিকে, আমরা যেন কার বুদ্ধিতে উল্টোরথে চেপে বসি!
তাই আমরা আফসোস করব না। আমরা বিলাসবহুল বাসে করে যাতায়াত করব হালের গরু বেচে। টাকায় না পোষালে ভাঙাচোরা লঞ্চে করে ডুবে মরব নদীতেÑআফসোস করব না। কেন করব? খামোকা তাই কান্নাকাটি করে লাভ নেই। আমরা বরং এটা মেনে নিই। যেমন মেনে নিয়েছিলাম আদমজী জুট মিলের বন্ধ হয়ে যাওয়া। যেমন করে মেনে নিই আমরা নিয়তি!
6 August 2008
তারিখে লেখাটি প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয়তে প্রকাশিত হয়েছিল। বাগেরহাট-রূপসা রেললাইন তুলে ফেলার প্রতিক্রিয়ায়।
ট্রেনলাইন তুলে ফেলার দৃশ্য দেখতে নাকি হাজার হাজার মানুষ জড় হয়েছিল। তারা নাকি আহাজারি করেছে; নেতাদের গালি দিয়েছে। কেউ কেউ পুরোনো দিনের কথা মনে করে চোখের জলও ফেলেছে।
আমাদের এই ডিজিটাল দুনিয়ায় বসে একটা ট্রেনলাইনের মৃত্যুতে চোখের জল ফেলাকে ন্যাকামো মনে হতে পারে। এই জল আবেগাক্রান্ত মানুষের বাড়াবাড়ি ভাবাটাও দোষের নয়। কিন্তু এই ব্যাপারটা ঠিক যুক্তি দিয়ে, কাগুজে কথা দিয়ে বোঝানো যাবে না। সেই ১৯১৮ সালে ‘মেসার্স অম্বলাল অ্যান্ড হিমাতলাল’ নামের প্রতিষ্ঠানটি যে বাষ্পশকট এখানে বসিয়েছিলেন, তার সঙ্গে কীভাবে হাজার হাজার মানুষের আত্মা জড়িয়ে গেল, সেটা যুক্তি দিয়ে বোঝানো কঠিন। নদীপ্রধান এলাকা বাগেরহাট, খুলনার মাঝখানে এই যন্ত্রদানব একেবারে বাড়ির পোষা হাতিটা হয়ে উঠেছিল মানুষের কাছে।
আমাদের ছোটবেলায় মামাবাড়ি যাওয়ার মাধ্যম ছিল এই ট্রেন। তখনো কাটাখালী হয়ে বাগেরহাট-রূপসা মহাসড়কের জন্ম হয়নি। মামারা আমাদের নিতে আসতেন। ভোররাতে উঠে নাক, চোখ মুছতে মুছতে রওনা হতাম ট্রেনের উদ্দেশে। কয়েক ঘণ্টা দেরি করে একসময় ছেড়ে দিত ট্রেন। বগিতে চাপা একটা গন্ধ, লেবু-আঙ্গুর বিক্রেতার হাঁকাহাঁকি। আমাদের বুকে আগুন জ্বালিয়ে একটু বড়রা চলন্ত ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতেন। দোলায় দোলায় ঘুম পেয়ে যেত। এর মাঝে আবার সিঙ্গাতি বলে একটা স্টেশনে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকত ট্রেন। ওপাশ থেকে আরেকটা ট্রেন আসছে, তাকে জায়গা করে দিতে হবে। আমরা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শুনতাম ‘কু-উ-উ...’।
পাশ থেকে মা মাথাটা টেনে নিয়ে কোলে চেপে ধরে বলতেন, ‘বাইরে মাথা দিস না..।’ এই সব সম্পর্কের কথা কি যুক্তি দিয়ে বোঝানো যাবে?
তবে চূড়ান্ত কথা হলো, আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না। ট্রেনের মতো একটা ব্যয়বহুল ব্যাপার লাভছাড়া টিকিয়ে রাখবে রাষ্ট্র: এটা ভাবা তো অন্যায়। আর এখানে বলা হচ্ছিল, রূপসা-বাগেরহাট রেল নাকি লোকসানই করে যাচ্ছে। ১৯৯৭ সালে অনেক আপত্তি, স্কুল-কলেজের স্বপ্নবাজ ছেলেদের বাধা অতিক্রম করে ট্রেনটা যখন বন্ধ করে দেওয়া হয়, বলা হয়েছিল, ৫০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে, এখানে ট্রেন চালাতে গিয়ে। বাগেরহাট-রূপসার ট্রেন আমাদের কাছে স্মৃতিকাতরতার ব্যাপার হতে পারে, প্রয়োজনীয় একটা বাহন হতে পারে; তাতে রাষ্ট্রের কী? রেলওয়ের কী? তারা কেন গাঁটের পয়সা খরচ করে হাতি পুষবে! তাদের যুক্তি তো ঠিকই ছিল।
আসলেই কি তাই? আমাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু তা বলে না। বলা হচ্ছিল, বাগেরহাট-খুলনার ফাঁকিবাজ লোকেরা টিকিট না কেটে কেটে রেলওয়ের বারোটা বাজাচ্ছে। আসল চিত্র অন্য রকম ছিল বলেই জানতাম আমরা। ১৯৯০ সালে একবার এরশাদ সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী মহোদয়ও জোর উদ্যোগী হয়েছিলেন এই রেললাইনটা বন্ধ করে দিতে। তিনিও তোতাপাখির মতো এসব লোকসানের যুক্তি দিলে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাগেরহাটের বাসিন্দারা। রেল রার জন্য তখন অ্যাডভোকেট সামসুল হককে প্রধান করে একটা কমিটি করা হয়েছিল। সে কমিটি যা যা করেছে, তার ফিরিস্তি দিতে চাই না। অন্তত তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রীকে বাগেরহাটে যে ‘অভ্যর্থনা’ স্থানীয় লোকজন দিয়েছিল, সে ফিরিস্তি দেওয়া তো একেবারেই অন্যায়।
কিন্তু এই কমিটি একটা যুগান্তকারী কাজ করে ফেলেছিল তখন। ‘রেলে লোকসান’ শুনে শুনে কান পচে যাওয়ার জোগাড় হওয়ায়, তারা বাগেরহাটের পিসি কলেজের ছাত্রদের দিয়ে রেলের আয় পর্যবেণের জন্য একটা দল করে দিয়েছিল। সেই দলটি চারভাগে বিভক্ত হয়ে মাত্র চারটি স্টেশনে একটানা সাত দিন টিকিট বিক্রি তদারকি করেছিল। তাতে রেল কর্তৃপ ঠিক কত টাকা আয়ের মুখ দেখেছিল, তা পরিষ্কার না করলেও, প্রকাশ্যে তারা স্বীকৃতি দিয়েছিল, এই সাত দিন লাভে চলেছে রূপসা-বাগেরহাট রেল!
গোটাদশেক স্টেশনের মাত্র চারটিতে টিকিট বিক্রি তদারকি করে (তা-ও আবার ছাত্র ও দরিদ্রদের ছাড় হিসাব করেই) যদি সাত দিন রেলওয়ে লাভে চলে, তা হলে সারা বছর লোকসান করে কেন? ওই তদারকির অভাব? নাকি ভূত আরও ভেতরে?
কে জানে! এত দিন পরে আর এসব প্রশ্ন কাকে করা! আফসোস করে বোধহয় লাভ নেই। কারণ, আমাদের এখানে এটাই নিয়ম। সারা দুনিয়া চলে একদিকে, আমরা যেন কার বুদ্ধিতে উল্টোরথে চেপে বসি!
তাই আমরা আফসোস করব না। আমরা বিলাসবহুল বাসে করে যাতায়াত করব হালের গরু বেচে। টাকায় না পোষালে ভাঙাচোরা লঞ্চে করে ডুবে মরব নদীতেÑআফসোস করব না। কেন করব? খামোকা তাই কান্নাকাটি করে লাভ নেই। আমরা বরং এটা মেনে নিই। যেমন মেনে নিয়েছিলাম আদমজী জুট মিলের বন্ধ হয়ে যাওয়া। যেমন করে মেনে নিই আমরা নিয়তি!
6 August 2008
তারিখে লেখাটি প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয়তে প্রকাশিত হয়েছিল। বাগেরহাট-রূপসা রেললাইন তুলে ফেলার প্রতিক্রিয়ায়।
Facebook comments for blogger brought to you by AllBlogTools.com