বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন, ২০১১

সাংবাদিক নির্যাতন: লজ্জা কার, দায় কার?

অনেক দিন পর।
মাঝে ক টা দিন গ্রামের বাড়িতে কাটল। সুখকর, বিস্ময়কর কিছু অভিজ্ঞতা হল। ভেবেছিলাম, বিরতি শেষে সে সব নিয়ে বেশ শাসালো, রসালো একটা পোস্ট দেওয়া যাবে।

তা আর হলো কই? দুপুর থেকে টিভিতে খবর দেখছি: আমাদের কয়েক জন সতীর্থ সাংবাদিক পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। সাংবাদিক পেটানোর পুরোনো এই সংস্কৃতি আর গেল না।
খবরগুলো শোনার পর থেকে পুলিশের লোকদের খুব অভিশাপ দিচ্ছিলাম। আর নিজেদের জন্য করুনা হচ্ছিল।
এভাবে হরতালে, অবরোধে, শান্তিতে; সাংবাদিক পেটানো হবে কেন?
আবার নিজেই ভাবি, আমাদের বেশিরভাগ পুলিশ তো আমাদের ভাষায় ‘অশিক্ষিত’ ও ‘অসংস্কৃত’; এদের কাছ থেকে পিটুনি পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে আমাদের আচরণটা আসলে কেমন? আমরা সাংবাদিকরা পুলিশ দেখলেই যেমন আচরণ করি, সেটা কতোটা শিক্ষিতের লক্ষন?
আমার অবিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে একদমই নেতিবাচক। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকবার পুলিশের মুখোমুখি হয়েছি। দেখেছি, অত্যন্ত বিস্ময়কর ভাবে পুলিশ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের সামনে খানিকটা সময় হলেও বিনীত আচরণ করতে থাকেন। আমরা আমরা একটা আইডি কার্ডের জোরে যাচ্ছে তাই আচরণ শুরু করি, গালিগালাজ করি, কলারও ধরে ফেলি!!
আমি আজ ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বিস্তারিত জানি না। ফলে এখানে কোন পক্ষের দায় ছিল তাও বলতে পারি না। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ-সাংবাদিক দাঙ্গাটা শুরু হয় আমাদের পক্ষ থেকে, সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে। সামান্য কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পুলিশের কলার চেপে ধরা, ব্যাচ ছিড়ে ফেলার মতো রীতিমতো ভয়াবহ কাজ করতে দেখেছি চোখের সামনে।
কথা হল, সাংবাদিককে তার কার্ড এরকম কিছু করার অধিকার দেয় কি না? আদৌ সাংবাদিকের কার্ড কি তাকে কোনো রকম বিশেষ অধিকার দিয়ে থাকে? নাকি এটা একটা দায়িত্ব ও বাড়তি বিনয় বজায়ে রাখতে বলে?
সাংবাদিকের পরিচয়পত্র তাকে বিশেষ কিছু জায়গায় প্রবেশ ও কথা বলার সুযোগ দেয়; কোনো অধিকার দেয় না। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এই পরিচয়পত্রটাকে একটা লাইসেন্স বলে মনে করে; লাইসেন্স টু হিট, লাইসেন্স টু হিউমিলেট সামওয়ান!!!
আর এই পরিচয়পত্র নিয়ে আমরা কাকে ‘হিট’ করি, কাকে ‘হিউমিলেট’ করি? রাষ্ট্রের নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীকে! হ্যা, সেই নিরাপত্তাকর্মী হয়তো শিক্ষাগত যোগ্যতায় কোনো সাংবাদিকের চেয়ে পিছিয়ে আবার কখনো এগিয়ে। সেই নিরাপত্তাকর্মী হয়তো দুর্নীতিগ্রস্থ। তারপরও সে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। তার বিচার করার অধিকার কি একজন বেসামরিকে সাংবাদিকের আছে??
আমি আমার এই লেখা দিয়ে কোনোভাবেই পুলিশের কোনো কর্মকান্ড যায়েজ করছি না। আমার চৌদ্দ গুষ্ঠিতে কেউ পুলিশ নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের পুলিশ কাঠামো নিয়ে শত শত অভিযোগ আমারও আছে।
কিন্তু কথা হল; আমরা সাংবাদিকরা সাধারণ মানুষের চোখ-কান হিসেবে কাজ করি। আমরা অসংযত ও চরম রাষ্ট্রবিরোধী সব আচরণ করলে ‘এইট পাশ’ পুলিশের কাছ থেকে কি আশা করতে পারি?
সবশেষে যারা পুলিশের হাতে আহত হয়েছেন, তাদের প্রতি আবারও সহানুভূতি। সঙ্গে আমরা সাংবাদিকরা নিজেদের এক্তিয়ার, অওকাত আর যোগ্যতা সম্পর্ আরেকটু সচেতন হব, এই আশায়।

সংযোজন:
লেখার পর মনে হল, আমি সাংবাদিক হয়েও এই লেখা কেন লিখলাম, তার একটা ব্যাখ্যা থাকা দরকার। আমি ভয় পাই, যে ‘ক্ষমতা’র দাপট আমরা পুলিশের সঙ্গে দেখাচ্ছি; তার একটা ভয়াবহ পরিণতি আছে।পুলিশের কোনো পত্রিকা নেই, তাই তাদের ভাষ্যটা মানুষ জানতে পারে না। তারা যে প্রতিবাদ পাঠায় তাকে আমরা আরও হাস্যকর করে তুলে দিনকে দিন নিরাপত্তাবাহিনীকে মানুষের কাছে হাস্যকর উপাদানে পরিণত করছি।
কিন্তু এর ভবিষ্যত ভালো না। এই ‘ক্ষমতা’ দেখানো অভ্যেস এক সময় সাধারণ মানুষের ওপরও প্রয়োগ হতে শুরু হবে। তখন মানুষ আর সাংবাদিক মুখোমুখি হয়ে যাবে। আমি ভয় পাই নিজেদের ভেতর থেকে কোনদিন সেই দৈত্য বেরিয়ে আসে, আর আমরা জাতীয় ঘৃনার চিরিত্রে না পরিণত হই!!!

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites