আ হ ম মোস্তফা কামাল: এফসেএ, এমপি এবং একটি সংসদীয় কমিটির প্রধান।
মানুষ হিসেবে মোস্তফা কামাল সাহেবের অতীত ও বর্তমান বলে, তিনি একজন যোগ্য মানুষ। শুনেছি, সেই পাকিস্তান আমলে দুই পাকিস্তান মিলিয়ে সিএ-এর সেরা ছাত্র হিসেবে ‘লোটাস’ উপাধি পেয়েছিলেন। সে জন্যই ঘনিষ্ঠরা তাকে লোটাস কামাল বলে ডাকেন।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে, মানে সবকিছু যদি মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী এগোয়, তাহলে ২০১৪ সালে আইসিসির সভাপতি হতে যাচ্ছেন আমাদের এই লোটাস কামাল। আমি সবিনয়ে এই জায়গাটা নিয়ে একটু কথা বলতে চাই।
আগে বলি, কামাল সাহেব কিভাবে আইসিসির সভাপতি হতে পারেন।
আইসিসি বর্তমানে তার সভাপতি নির্বাচন করে আবর্তন (রোটেশন) নীতিতে। এই নীতিতে প্রতি দুটি করে দেশ নির্দিষ্ট সময় অন্তর সভাপতি ও সহসভাপতি নির্বাচন করার সুযোগ পায়।
সম্প্রতি ভারতসহ কিছু দেশ মনে করছে, আইসিসির এই আবর্তন নীতিটি আর থাকা উচিত নয়। এখানে সুস্পষ্ট ভোটাভুটির মাধ্যমেই সভাপতি নির্বাচন করা উচিত। মনে করার কারণ স্পষ্ট: ভারতের আবর্তন কোটা শরদ পাওয়ারকে দিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা নির্বাচন চালু করে আবার ভারতীয় কাউকে ওই পদে বসাতে চায়।
সদ্য শেষ হওয়া হংকং কংগ্রেসেই আবর্তন নীতি বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি দেশ (সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকা)-এর আপত্তিতে তা হতে পারেনি।
বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যুক্তি সহজ; ২০১৪ সালে আবর্তন অনুযায়ী সভাপতি-সহসভাপতি তাদের দেশ থেকে দেওয়ার কথা।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সে পর্যন্ত এই নীতি টিকে যাবে। অর্থাৎ, ২০১৪ সালে আইসিসির প্রধান দুটি পদ অলঙ্কৃত করবেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সে সময়ের বোর্ড সভাপতি। এখানে একটু ফুটনোট আছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ-পাকিস্তান যখন এই সুযোগ পেয়েছিল, তখন প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন পাকিস্তানের এহসান মানি। সে সময়ের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এবার প্রেসিডেন্ট পদটা বাংলাদেশকে ছেড়ে দেওয়ার কথা পাকিস্তানের।
এবার দেখা যাক, কামাল সাহেবের স্বপ্নটা কি? তিনি যদি সেই পর্যন্ত পদে থাকতে পারেন, তাহলে তারই বসার কথা ক্রিকেটের সর্বোচ্চ চেয়ারটিতে। অবশ্য এর মধ্যে দুটি নির্বাচন প্রভাব ফেলবে। এক. বোর্ড সভাপতি পদে নির্বাচন করতে হবে। দুই. জাতীয় নির্বাচন হয়ে যাবে।
স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী নেতা কামাল সাহেব ধরে নিচ্ছেন, জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলিগ আবার ক্ষমতায় আসবে।(যদিও সেটা ভোটেই ঠিক হবে শেষ পর্যন্ত!)
থাকল বাকি বোর্ড সভাপতি পদে নির্বাচন। এখানেও কামাল সাহেবের জোর আশাবাদের কারণ আছে। আমাদের দেশে এই ধরণের নির্বাচন কখনোই সত্যিকারের ভোটের প্রতিফলন করে না। বিসিবি আইসিসির চাপে নির্বাচন ঠিকই দেবে। কিন্তু সেখান থেকে আওয়ামীলিগ মনোনীত প্রার্থীই পাশ করে আসবে।
কারণ, এই ভোটে যারা কাউন্সিলর তারা এতো বিপ্লবী নন যে, আওয়ামীলিগ যাকে চায় তাকে না এনে অন্য কাউকে ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট বানাবেন। সেক্ষেত্রে আওয়ামীলিগ তাকে মনোনয়ন দিলে কামাল সাহেবই যে নির্বাচিত হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ করার সুযোগ নেই।
এ পর্যন্ত ছক ঠিক থাকলে আ হ ম মোস্তফা কামালের আইসিসি সভাপতি হওয়া খুব সম্ভব।
আমি গত দু দিন ধরে এই ব্যাপারটি নিয়ে খুব শঙ্কার মধ্যে আছি। সবকিছু এভাবে হলে সত্যিই যদি কামাল সাহেব আইসিসি সভাপতি হয়ে যান, সেটা ছোটখাটো একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
কামাল সাহেবকে এই ক বছর ধরে বিসিবি সভাপতি হিসেবে যা কান্ড কারখানা করতে দেখেছি, তাতে এরকম একটা বৈশ্বিক চেয়ারে তিনি বসলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতেও টান পড়ে যেতে পারে।
প্রথম কথা হল, এই ভদ্রলোক সংবাদ মাধ্যম (বিশেষ করে টিভি ক্যামেরার সামনে) উল্টোপাল্টা মন্তব্য, ভবিষ্যত না ভেবে কথা বলে ফেলতে খুব ওস্তাদ। কয়েকবার করে এরকম কেলেঙ্কারি তিনি করেছেন। একবার বলে দিলেন, ল্যান্স ক্লুজনার বাংলাদেশের বোলিং কোচ হচ্ছেন; কথাবার্তা চূড়ান্ত। পরে ক্লুজনার বললেন, তার সঙ্গে তেমন কোনো কথাই হয়নি।
এই কিছুদিন আগে বললেন, দক্ষিন আফ্রিকান ভিনসেন্ট বার্নেসের কথা বললেন। বললেন, বার্নেসের সঙ্গে তার কথাবার্তা চূড়ান্ত; তিনিই হচ্ছেন জাতীয় দলের কোচ। ক দিন পর বার্নেস বললেন, তাকে প্রাথমিক একটা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তিনি ‘হ্যা, না’ কিছু বলেননি।
বুঝুন অবস্থাটা।
এই দুটো উদাহরন আপাতত সামনে এলো। এ ছাড়া এরকম গুলিয়ে ফেলার ঘটনা কামাল সাহেবের আরও অনেক পাওয়া যাবে। এখন কথা হল, আইসিসির চেয়ারে বসে এরকম সব কান্ড কারখানা করতে থাকলে, সেই দায়টা লোকে কাকে দেবে?
আমরা যখন শরদ পাওয়ারকে গালি দেই, ‘ভারতীয় রাজনীতিবিদ’ বলেই গালি দেই। আমাদেরও কি তাহলে একদিন এই গালি শুনতে হবে?
এই প্রশ্নটার উত্তর একজন মানুষই দিতে পারেন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনিই ঠিক করতে পারেন, কামাল সাহেব বিসিবি সভাপতি পদে টিকে থাকবেন কিনা। তিনিই ঠিক করতে পারেন, বাংলাদেশকে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হবে কি না।
প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে আওয়ামী মনোনীত বিসিবি সভাপতি প্রার্থী কে হবেন?
স্মৃতিভ্রষ্ট না হলে যোগ্যতম মানুষটির নাম সবার একবাক্যে বলে ওঠার কথা: জনাব সাবের হোসেন চৌধুরী।
আমি সাবের হোসেন চৌধুরীর খাইও না, পরিও না। তার পত্রিকাতেও কোনোদিন কাজ করিনি। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, ক্রিকেট সংগঠক বলতে যা বোঝায়; তা এই দেশে একজন থাকলেও তিনি সাবের হোসেন চৌধুরী।
যে মানুষটি ১৯৯৭ সালে বলেন, আমরা টেস্ট খেলবো। এবং সেই অনুযায়ী টেস্ট স্টাটাস এনে দিতে পারেন, তার বিসিবি সভাপতি হতে আর কোনো যোগ্যতা লাগে না। দুরদর্শিতা বলুন, পরিকল্পনা বলুন; মিথ্যের এই রাজনীতির যুগে একমাত্র সাবের হোসেন চৌধুরীর পক্ষে বাংলাদেশ থেকে গিয়ে আইসিসির ওই চেয়ারটায় বসার সত্যিকারের যোগ্যতা আছে।
কিন্তু কথা হল, এই অনুরোধ আমরা কাকে করবো? প্রধানমন্ত্রীকে!
তিনি তো অদ্ভুত এক নীতি নিয়ে বসে আছেন। যে নীতিতে তথাকথিত সংস্কারপন্থিদের কোনো ঠাই তার কাছে নেই। সাবের ভাই যতোদুর জানি বছর আটেক আগেও শেখ হাসিনার প্রিয় মানুষগুলোর একজন ছিলেন। কিন্তু কি এক ওয়ান ইলেভেন এলো। বদলে গেল সব।
সাবের হোসেন চৌধুরীকে রেখে একজন শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতাকে (নিন্দুকের ভাষায়)বসানো হল বিসিবি সভাপতির চেয়ারে। এই কাজ করা হয়েছে ক্রীড়ামন্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও।
মানুষ কেমন জানি না। ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে ওবায়দুল কাদের অন্তত যাচ্ছেতাই ছিলেন না। কিন্তু শুধু সংস্কারপন্থি নন, এই যোগ্যতায় ক্রীড়ামন্ত্রী হয়ে দিনের পর দিন চায়ের আড্ডায় হাসির খোরাক হয়ে যাচ্ছেন একজন আহাদ আলী সরকার।
আমি আহাদ সাহেব বা কামাল সাহেবকে ছোট করছি না। তবে তারা আসলে এই পদগুলোর জন্য নন।
যদি প্রধানমন্ত্রী কোনোদিন, কোনো দূর্ঘটনাচক্রে এই লেখা পড়েন, তাহলে একটা অনুরোধ করবো: যোগ্য মানুষগুলোর ভুলটা ভুলে যাওয়াও একটা যোগ্যতা। এতে আর কিছু না হোক দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা পায়।
একবারের জন্য হলেও সব ভুলে গিয়ে দেশের ভাবমূর্তির কথা ভেবে বিসিবি সভাপতি ও ক্রীড়ামন্ত্রীর ব্যাপারটি আরেকবার বিচেনা করুন।
[এটি নিতান্তই নিস্ফল ক্রন্দন। এই ক্রন্দনে কারো লাভ হবে না, জানি। তবে যারা পড়ছেন, তাদের নিশ্চিত করতে চাই আ হ ম মোস্তফা কামাল বা আহাদ আলী সরকারকে হেয় করার কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই।]