মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০১১

আরেক জন




বুকে চাপা একটা ব্যথা। নিঃশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল সাজিদ, সাজিদ হায়দার। দেয়ালে হেলান দিয়ে বড় বড় করে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল। দর দর করে ঘামছে। হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে পানির বোতল টেনে নিল। পর পর দু ঢোক পানি খেয়ে একটু সম্বিত ফিরে পেল। বুঝতে পারল, মরে যাচ্ছে না। আবার সেই স্বপ্নটা দেখেছে।
স্বপ্নটা এমন মারাত্মক কিছু না। ঘটনা শুরু হয় বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের ঠিক আগে। বাংলাদেশ দলের বাহাতি ওপেনার সাজিদ স্বপ্নে দেখে, ড্রেসিংরুমে পৌছাতে তার দেরী হয়ে যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে ড্রেসিংরুমের এলাকায়, মানে জোন-ওয়ানে ঢোকার মুখে তাকে আটকে দেয় এক সিকিউরিটির লোক।
ওই লোকটার চেহারা রোজ বদলে যায়। সিকিউরিটির লোকটাকে কোনোদিন বোর্ড প্রেসিডেন্টের মতো দেখা যায়, কোনো দিন কোচ জেমি সিডন্সের মতো। সিকিউরিটির লোকটাকে সাজিদ কিছুতেই বোঝাতে পারে না, সে বাংলাদেশ দলের ওপেনার। তাকে ছাড়া এই খেলা শুরু হতে পারে না।
রোজই সিকিউরিটির লোকটা এই পর্যায়ে হেসে দেয়। ড্রাকুলার মতো মুখ করে সে প্রত্যেক দিন বলে, ‘কে বলে, খেলা শুরু হবে না! ওই দ্যাখেন...’
লোকটার আঙুল অনুসরণ করে সাজিদ তাকায় ড্রেসিংরুমের বিশাল টেলিভিশনে। দেখতে পায় শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ। তার চেয়েও তাজ্জব ব্যাপার, বাংলাদেশ দল ব্যাটিংই বেছে নিয়েছে টসে জিতে। তাহলে সাজিদের বদলে ব্যাট করছে কে?
ঠিক এই সময় প্রতিদিন টেলিভিশনে দুই ওপেনারের মুখ দেখা যায়। সাজিদের দিকে চেয়ে হেলমেটের ফাক থেকে মৃদু মৃদু হাসে সাজিদ। বুকে চাপা একটা ব্যাথা শুরু হয়, ঘুম ভেঙে যায় সাজিদের।
আর দশ জন লোক এই স্বপ্ন দেখলে হয়তো মোটেও আতঙ্কিত হতেন না। কিন্তু সাজিদ কেন যেন খুবই ভয় পাচ্ছে এই স্বপ্ন দেখেÑরোজ কেন সে এই একই স্বপ্ন দেখছে। আমি-আপনি হলে এই ভয় পাওয়ায়ও কিচ্ছু আসতো যেত না। কিন্তু সাজিদ তো জাতীয় দলের ক্রিকেটার। তার ভয় পাওয়ায় অনেক কিছু যায় আসে।
সাজিদকে অবশ্য ঠিক জাতীয় দলের খেলোয়াড় বলা যাবে না। তার এখনও অভিষেক হয়নি। অভিষেকটা হবে পাকিস্তানের বিপক্ষে। আগামী সপ্তাহে ম্যাচ। পনেরো সদস্যের দলে ডাক পেয়েছে সে। এবারের লিগে সাজিদের যে রান আর জাতীয় দলের দুই ওপেনারের যে ফর্ম; তাতে সাজিদের অভিষেকটা এখন সময়ের ব্যাপার।
কিন্তু এই স্বপ্নটা শুরু হওয়ার পর থেকে ব্যাপারটার আর এতো নিশ্চিত নেই। রাতের স্বপ্নে দেখা এই ভয়টা সারাদিন সাজিদের সঙ্গে থাকে। নেটে ব্যাটিংয়ের সময়ও পিছু ছাড়ে না। ফলে লিগের সেই সাজিদকে গত তিন-চার দিন ধরে নেটে ঠিক পাওয়া যাচ্ছে না।
এমনকি এই সেদিন ‘এ’ দলের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচেও মাত্র ২৭ রান করেই বোল্ড হয়ে ফিরে এসেছে সাজিদ। ওই পর্যন্ত স্বচ্ছন্দে ব্যাট করছিল। তারপরই স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল। অফস্পিনারের সোজা আসা বলটা কি ভেবে যেন ছেড়ে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে সাজিদের নিশ্চিত অভিষেকটায় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসিয়ে দিলেন, মাঠের পাশে বসে থাকা কোচ। ইংরেজীতে প্রধান নির্বাচককে যা বললেন, তার অর্থ এরকম, ‘এই তোমাদের দারুণ পারফরমার! এর চেয়ে তো দলে যারা আছে, ওরা ভালো...’
প্রধান নির্বাচক আমতা আমতা করে বললেন, ‘কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে ওর। নইলে এই বলে তো ওর ভুল করার কথা না।’
কোচ-নির্বাচকের এই আলোচনাটা সাজিদ মোটেও শুনতে পায়নি। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছে, ঝামেলা হয়ে যাবে। ঝামেলা থেকে বাচতেই দলের সঙ্গে শৌখিনভাবে ঘুড়ে বেড়ানো মনস্তত্ত্ববিদ শুভঙ্কর রায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল সাজিদ।
সিলেটের ছেলে সাজিদ, এসব মনস্তত্ত্ববিদ-টিদকে কোনোদিন পাত্তা দেয়নি। তারপরও রুমমেট রাজ্জাক ভাইয়ের কথায় শুভঙ্করদার কাছে গেল। সব শুনে টুনে থিওরি অব রিলেটিভিটিআবার আবিস্কারের মতো মুখ করে ফেললেন শুভঙ্কর রায়,
‘আরে সাজিদ! এটা কোনো ব্যাপার হল? তুমি পড়াশোনা করা ছেলে, এমন স্বপ্নের কারণ তো নিজে ভেবেই বের করতে পারো।’
সাজিদ পড়াশোনা জানা ছেলেÑএটা কিন্তু সত্যি কথা। ক্রিকেটের ফাকেই কিভাবে কি করে যেন সে বেশ ভালো ছাত্র হিসেবে নিজেকে ধরে রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিজ্ঞানের মতো ভয়ঙ্কর একটা বিষয়ে পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু এই পড়াশোনা দিয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা কিভাবে খুজে পাওয়া যাবে, সেটা সাজিদ ঠিক বুঝওতে পারল না। নাকি শুভঙ্করদা পড়াশোনা বলতে ‘খোয়াবনামা’ পড়া বোঝাতে চেয়েছেন। কিছুই বুঝতে না পেরে সাজিদ বললো,
‘কিন্তু দাদা, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
শুভঙ্কর বাবু খুব মজা পেলেন, ‘আরে দূর! এটা কোনো ব্যাপারই না। তুমি জাতীয় দলে প্রথম খেলতে যাচ্ছো, তাই এখন নিজের খেলা নিয়ে অবচেতন মনে নানারকম শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। জাতীয় দলে খেলাটা তো তোমার কাছে স্বপ্নের মতো। তুমি ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছো, স্বপ্নটা না ভেঙে যায়।’
‘না তো! এরকম ভয় তো পাচ্ছি না।’
‘পাচ্ছো। তুমি যে এই ভয় পাচ্ছো, তা তোমার সচেতন মন জানে না।’
‘তাই নাকি!’
‘ফলে যেটা হচ্ছে... তোমার অবচেতন মনের এই ভয়ের ফলে তুমি অভিষেকের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছ।’
সাজিদ সামান্য হলেও যুক্তি খুজে পেল শুভঙ্করদার কথায়। মনে হল, এটা হলেও হতে পারে। খানিক্ষন মাথা-টাথা চুলকে বললো,
‘তাহলে এখন আমি কি করবো?’
‘কিচ্ছু না। ব্যাপারটা বুঝেছ। আর এটাকে পাত্তা দিও না। তাহলেই স্বপ্নটা আর দেখবে না।’
কাশ সিক্স থেকে এ পর্যন্ত যে পরিমানে সেবা প্রকাশনীর বই সাজিদ পড়েছে, তাতে শুভঙ্করদার ব্যাখ্যা মেনে নিতে খুব কষ্ট হল না। নিজেকে বরং উপন্যাসের কোনো চরিত্র মনে করে নিয়েই শুভঙ্করদার রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
ড্রেসিংরুম হয়ে যখন মাঠে পা রাখল, ততক্ষনে সাজিদের মন ভালো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, এখন চাইলেই সেন্টার উইকেটে গিয়ে একটা সেঞ্চুরি মেরে আসতে পারবে সে।
তিন-চার দিন পর এমন উজ্জ্বল চেহারার সাজিদকে দেখে এগিয়ে এলো ওদের ক্যাপ্টেন। আজ প্র্যাকটিস নেই। তারপরও কেউ ফিজিওর সঙ্গে কাজ করতে, কেউ নেটে নক করতে; অনেকেই মাঠে চলে এসেছে। ক্যাপ্টেন কাছে এসে বললো, ‘কি মিয়া, তুমি নাকি কি সব স্বপ্ন দেখছ আজকাল?’
সাজিদ মুদু হাসল। ওদের ক্যাপ্টেন বেশ রসিক মানুষ। সাজিদের বেশ পছন্দ হয়েছে। সাজিদ কিছু বলছে না দেখে আবার সেই বললো, ‘যাই স্বপ্ন দ্যাখো ক্ষতি নেই। তবে আসল স্বপ্নের কথা মাথায় রেখো...’
সাজিদও কিছু একটা বলতে গিয়েছিল। তার আগেই রিং রিং করে উঠল ওর মোবাইল। ইচ্ছে করে এরকম আদ্দিকালের ফোনের রিং টোন লাগিয়ে রেখেছে ও। ক্যাপ্টেনের সামনে ফোন ধরতে চাচ্ছিল না। কিন্তু ক্যাপ্টেনই হেসে বললো, ‘ক্যারি অন। ফোন ধরো। দ্যাখো কোনো ভক্ত-টক্ত নাকি...’
হেসে ফোনটা কানে ছোয়ালো সাজিদ। ওপাশ থেকে খুব চেনা একটা কণ্ঠ শোনা গেল,
‘হ্যালো। সাজিদ বলছেন?’
কণ্ঠটা চেনার চেষ্টা করছে সাজিদ, ‘হ্যা। আপনি কে?’
‘আমি আপনার খুব কাছে মানুষ।’
সাজিদ ভাবছে আর কথা বলছে, ‘কে? কি বলতে চান?’
‘স্বপ্নটা এখনো দেখছ সাজিদ?’
সাজিদ প্রথমটা উত্তর খুজে পেল না, ‘কি স্বপ্ন? কে বলছিলেন?’
‘ওই যে তোমার বদলে আরেক জন খেলছে, সেই স্বপ্নটা...’
‘কে আপনি? এই স্বপ্নের কথা কিভাবে জানলেন? কে বললো আপনাকে?’Ñস্বপ্নটার বিস্তারিত তো শুভঙ্করদা ছাড়া কেউ জানে না! তাহলে কি শুভঙ্করদাই বলেছে?
‘আমাকে কেউ বলেনি সাজিদ। আমি তোমার সব স্বপ্নের কথা জানি।’
‘কিভাবে!’Ñচিৎকার করে উঠল সাজিদ। ওর ক্যাপ্টেন অবাক হয়ে চেয়ে রইল।
‘খুব সোজা। কারণ, তোমাকে স্বপ্নটা আমি দেখাচ্ছি।’
সাজিদ আর কোনো কথা খুজে পেল না। ওপাশের কণ্ঠটা একটু বিরতি দিয়ে আবার বললো, ‘সাজিদ, তোমার অভিষেক হবে না। আরেক জন খেলবে তোমার বদলে।’
কোনোক্রমে ধরা গলায় সাজিদ জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কি চান?’
‘আমি চাই আমার স্বপ্নপূরন করতে।’
সাজিদ কথা বলতে পারছিল না। তারপরও নিজেকে যেন পাতাল থেকে টেনে তুলে বললো, ‘কে আপনি?’
‘আমিও সাজিদ।’
সাজিদ এবার কণ্ঠটা চিনতে পেরেছে।
****
সাজিদের ব্যাপারটা সিনেমার কাহিনী বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত। অন্তত শুরুতে রাজ্জাক ভাই আর শুভঙ্করদা তাই চাচ্ছিল। শুভঙ্করদা জোর দিয়ে বলছিল, এমন কোনো ফোন আসেনি। কিন্তু ক্যাপ্টেন সামান্য সাজিদের পক্ষ নিল।
ক্যাপ্টেনের মোহাম্মদপুরের বাসায় বসে আলোচনা হচ্ছিল। এখনও ব্যাপারটা এই চার জনের বাইরে কাউকে জানানো হয়নি। জানালে হাসা-হাসি করার লোকসংখ্যা বাড়া ছাড়া আর কিছু হতো না। সঙ্গে সাজিদের অভিষেকটা আরও ঝুকির মধ্যে পড়ে যেত।
আপাতত অবশ্য ক্যাপ্টেন ওকে ভরসাই দিয়ে যাচ্ছেন, ‘দ্যাখো, সাজিদ, আমি বিশ্বাস-অবিশ্বাস কিছুই করছি না। কিন্তু এটুকু জানি যে, এই ঝামেলাটাকে তোমার এড়াতে হবে। এই ঝামেলা মাথায় নিয়ে তুমি ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ খেলতে পারবে না। আমি জানি, তুমি ঝামেলাটা এড়াতে পারবে।’
রাজ্জাক ভাই চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে বললো, ‘না পারার তো কোনো কারণই দেখছি না। আমার তো মনে হয়, সাজিদ পুরো ব্যাপারটা কল্পনা করছে...’।
রাজ্জাক ভাইয়ের কথা মাটিতে তো দূরে থাক, টেবিলেও পড়তে দিলেন না শুভঙ্করদা, ‘অবশ্যই কল্পনা করেছে। স্বপ্নটা দেখতেই পারে। কিন্তু ফোনটা ওর কল্পনা...’।
সাজিদকে কিছু বলতে হল না। ক্যাপ্টেনই জবাব দিল, ‘তা হয় কি করে! ফোন যে এলো, সেটা তো আমারই সামনে।’
শুভঙ্কর রায় এবার চোখমুখ শক্ত করে বললেন, ‘সাজিদ মন খারাপ করো না। আমি একটু আমার মতো করে ব্যাখ্যা দেই?’
সাজিদ ঘাড় নাড়ল, শুভঙ্করদা বললেন, ‘আসলে সাজিদকে এখন তার অবচেতন মনই নিয়ন্ত্রন করছে বলে আমার ধারণা। অন্য কোনো ফোন এসেছিল। ও সেটা কেটে দিয়ে ফোনে কাল্পনিক একটা চরিত্রের সঙ্গে কথা বলেছে। আসলে সে সময় ওই প্রান্তে কেউ ছিল না বলেই আমার ধারণা।’
ক্যাপ্টেনও একটু প্রভাবিত হল শুভঙ্করদার কথায়? হতে পারে। আলোচনা যতো আগেড় বাড়তে লাগল, ততোই সাজিদের মনে হল, এরা তিনজনই এখন ওকে মানসিক রোগী ভাবতে শুরু করেছে। এরা আর সাজিদের কোনো সাহায্য করতে পারবে না। সাজিদকে এখন যা করার নিজেকেই করতে হবে।
এখন সাজিদকে অপেক্ষা করতে হবে আবার ফোনের জন্য।
রাত তিনটের দিকে ফোন এলো। ফোন যে আসবে, সাজিদ জানতো। জানতো বলেই আজ ঘুমায়নি। ফোনটা সাইলেন্ট করে ভাইব্রেশন দিয়ে রেখেছে; যাতে রাজ্জাক ভাই কিছু টের না পায়। ভাইব্রেশন অবশ্য দেওয়ার দরকার ছিল না। ফোন থেকে এক মুহুর্তের জন্যও মনে হয় চোখ সরায়নি সাজিদ।
অবশেষে ঠিক তিনটে চৌদ্দ মিনিটে ফোনের আলোটা জ্বলে উঠলÑলেখা উঠল পধষষরহম ঁহশহড়হি হঁসনবৎ। ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে এলো সাজিদ। দুই রুমের বাসা। এক রুমে সাজিদ আর রাজ্জাক ভাই থাকে। আরেক রুমে সোহেল নামে রাজ্জাক ভাইয়ের এক বন্ধু থাকে। বরান্দায় চলে এলে আর কোনো সমস্যা নেই।
এবার আর ফোনটা ধরতে ভয় পেল না সাজিদ। নার্ভাসনেসটা কেটে গেছে। ও বুঝেছে জাতীয় দলের হয়ে খেলতে গেলে, এই খেলাটায় অংশ নিতে হবে ওর। নার্ভাস খেলোয়াড় কখনো জিততে পারে না।
ফোটা ধরেই সাবলীল গলায় সাজিদ বললো, ‘হ্যালো। কে বলছেন?’
ওপাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠ শোনা গেল, ‘আমিও সাজিদ।’
‘বলুন।’
‘কি হল? ক্যাপ্টেনের পরামর্শ নিয়ে কি লাভ হল?’
‘সবই তো জানেন। ওটা আর জিজ্ঞেস করে লাভ কি? এখন বলুন কি চান।’
‘চাই তো, একটাই জিনিস। তোমার অ্যাক্রিডেশন কার্ডটা।’
এবার সাজিদ না চমকে উঠে পারল না, ‘মানে?’
‘সাজিদ হিসেবে তোমার যা যা আছে, আমারও আছে। আমারও চেহারা তোমার মতো, আমারও ব্যাটিং তোমার মতো, আমার সবই কিছুই তোমার মতো; কারণ আমিও সাজিদ। আমার কাছে নেই শুধু ড্রেসিং রুমে ঢোকার অনুমতি। সেই অ্যাক্রিডেশন কার্ডটা দিতে হবে তোমার।’
‘এতো কিছু আপনি নিজে করতে পারলেন, এটা ম্যানেজ করুন না। আর আপনি চাইলেই আমি দেবো কেনো?’
‘দেবে সাজিদ, দেবে। তুমি এখনও বুঝতে পারোনি, আমি কি জিনিস। বুঝতে পারলেই দেবে।’
সাজিদ এবার খেলাটায় একটু মজা পাচ্ছে, ‘আপনিও বুঝতে পারেননি আমি কি জিনিস। আমি অ্যাক্রিডেশন কার্ড দেবো না।’
ওপাশ থেকে মৃদু একটা হাসির শব্দ শোনা গেল। লোকেদের ছেলেমানুষী দেখলে সাজিদ যেভাবে হাসে, তেমনই হাসি, ‘কাল ঠিক চারটের সময় তুমি কার্ডটা দিতে রাজী হয়ে যাবে। কারণ, তার ঠিক দশ মিনিট আগে তোমাদের বাসার সামনের চায়ের দোকানকার অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা যাবে।’
‘কি বলছেন এসব!’Ñনিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না সাজিদ।
‘হ্যা। ওটা হবে বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন দেখে যদি তুমি অ্যাক্রিডেশন কার্ড দিতে রাজী না হও, তাহলে দেখবে পুরো সিনেমা। সেই সিনেমার প্রথম দৃশ্যেই রাত বারোটায় সিলেটে তোমার বাবা মারা যাবেন ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে।’
‘ওই মিয়া! কি বলেন এগুলো!’Ñচিৎকার করে উঠল সাজিদ। কিন্তু সাজিদের সে চিৎকার শোনার জন্য ফোনের ওপাশে আরেক সাজিদ তখন আর নেই। লাইন কেটে দিয়েছে।
সাজিদের চিৎকার শুনে রাজ্জাক ভাই উঠে এসেছে, ‘কি হয়েছে?’
‘কিচ্ছু না।’Ñমুখ শক্ত করে দাড়িয়ে রইল সাজিদ। বেশিক্ষন দাড়িয়ে রইল না। আস্তে আস্তে ভেতরে হেটে গেল। ও খুব ভালো করে জানে, ওকে এখন রাজী হতেই হবে। কাল বিকেল ঠিক চারটেই ওকে রাজী হতে হবে। তারপরই জমবে খেলা।
কিন্তু খেলা জমার আগেই একটা লোককে মারা যেতে হবে। এই মৃত্যুটা সাজিদ চাইলেও ঠেকাতে পারে না, ঠেকাবে না। খেলা জমে ওঠার জন্যই মৃত্যুটা দরকার।
****
‘ক্যাপ্টেন, আমাকে নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই।’
সাজিদ কথাটা না বললেও চলতো। দু দিন ধরেই ক্যাপ্টেনের মনে হচ্ছে, সাজিদকে নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই।
সেই আগের মতো হাশি-খুশি, মনোযোগী সাজিদ ফিরে এসেছে। নেটে প্রত্যেকটা বল দেখেশুনে খেলছে। এমনকি আজ নিজেদের মধ্যে যে প্র্যাকটিস ম্যাচ ছিল, সেখানেও দুর্দান্ত করেছে। ৭২ বলে ৮৬ রানের অপরাজিত একটা ইনিংস খেলেছে।
ফলে, শুধু ক্যাপ্টেন না, সবাই বুঝতে পারছে, ওকে নিয়ে আর ভাবনার দরকার নেই। কোচ নিজে এসে সাজিদকে বলে গেছেন, ‘বি রেডি। আগামীকাল খেলছ তুমি।’
তারপরও ক্যাপ্টেন হেসে বললো, ‘সব সমস্যা মিটেছে?’
‘হ্যা। আসলেই আমার কল্পনা ছিল সবকিছু। এখন সব ঠিক হয়ে গেছে।’
ঠিক না হয়ে উপায় নেই। সাজিদ কথা দিয়ে দিয়েছে। পরশু ঠিক বিকেল তিনটে পঞ্চাশ মিনিটে রাস্তা পার হয়ে পানি আনতে গিয়ে ট্রাক চাপা পড়ে মারা গেছে ওদের বাসার সামনের চায়ের দোকানদার। কথা না দিয়ে আর উপায় ছিল না।
ঠিক চারটের সময় ফোন এসেছে। সাজিদ ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিল। ফোন না ধরে তো উপায় নেই। খেলা জমে গেছে। ও শুধু জানতে চেয়েছিল, খেলাটা কোথায় হবে, ‘কোথায় আসতে হবে অ্যাক্রিডেশন কার্ড নিয়ে?’
‘রমনা পার্কে।’
‘কখন?’
‘দেরী আছে। খেলার ঠিক আগের রাতে। আটটার সময় হোটেল থেকে বেরোবে। পার্কে আমার সঙ্গে দেখা হবে আটটা বিশ মিনিটে।’
‘পার্কে কোথায় থাকবেন আপনি?’
‘তা তোমাকে জানতে হবে না। তুমি বটমূলের কাছে দাড়িয়ে থাকবে।’
‘আচ্ছা। আমার কিছু কথা জানার ছিল।’
‘বলো।’
‘আপনি আসলে কে?’
‘সেটা তো বলা যাবে না। তবে এটুকু বলি যে, আমি আসলেই দেখতে তোমার মতো। অবশ্য আমি মোটেও ভালো ব্যাটিং করি না। আসলে আমি কখনোই ক্রিকেট খেলি না। আমি তোমাকে গত তিন বছর ধরে ফলো করছি। আমার জীবনের স্বপ্ন একটাইÑঅনেক টাকার মালিক হওয়া। তোমার বদলে আমি যদি জাতীয় দলে খেলি, তাহলে অনেক টাকার মালিক হতে পারবো।’
‘আজব কথা! আপনি ক্রিকেট খেলতে পারেন না, তাহলে ক্রিকেট খেলে অনেক টাকার মালিক হবেন কি করে?’
‘সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। যে লোক তোমাকে পর পর তিন রাত একই স্বপ্ন দেখাতে পারে, দেশের যে কোনো জায়গায় মানুষ মেরে ফেলতে পারে; সে রানও করতে পারবে। আমার দরকার শুধু একবার জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলা।’
‘ঠিক আছে। সে সুযোগ পাবেন আপনি।’
‘আরেকটু কথা আছে। তুমি ন্যাশনাল টিমের পোশাক পরবে না। কালো জিন্স পরবে আর এক্কেবারে সাদা একটা শার্ট।’
‘ঠিক আছে।’
সব কথায় রাজী হয়ে গেছে সাজিদ। রাজী না হয়ে উপায় নেই। খেলায় আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারি, বোলার; সব ওই সাজিদ। তাকে শুধু ব্যাট করতে হবে; স্লগ ওভারের ব্যাটিং। সেটা করতেই আজ রাতে বের হবে।
রাতে বেরোতে তেমন ঝক্কি পোহাতে হলো না। বললো, এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করবে শাহবাগে। ক্যাপ্টেন শুধু বললো, ‘রাত করো না। এমনিতে ম্যাচের আগের রাতে এরকম বেরোনো ঠিক না। শুধু তুমি বলে...’
‘টেনশন কইরেন না, ক্যাপ্টেন। আমার কিছু হবে না।’
সাজিদ একটু আগে বেরিয়ে পড়েছে। আসলেই শাহবাগে ওর এক বন্ধু অপেক্ষা করছিল। ইউনিভার্সিটির বন্ধু, রাজনীতি করে। আজিজ সুপার মার্কেটের কোনায় দাড়িয়ে ছিল।
সাজিদকে দেখেই এগিয়ে এলো, ‘কি রে, তোর এইসব মালের দরকার হলো কেনো?’
‘দরকার আছে। তোর বোঝার দরকার নেই। আর প্লিজ দোস, আমি যে এই জিনিসটা নিয়েছি, সেটা স্রেফ ভুলে যা।’
বন্ধুটা হতাশ একটা ভঙ্গি করে বললো, ‘ঠিক আছে।’
এবার কাধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা বোতল বের করে দিল সাজিদের হাতে। মুখে বললো, ‘সাবধানে হ্যান্ডেল করিস।’
সাজিদ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শুধু ‘থ্যাংকস’ বলেই হাটা দিল।
অবশ্য সাজিদের এমন কিছু দেরী হয়নি। বটমূলে পৌছে দেখে আটটা বাজতে তখনও তিন মিনিট বাকী। দীর্ঘদিন সিগারেট খায় না সাজিদ। আজ শখ করে একটা সিগারেট নিয়ে এসেছে। সিগারেটটা মুখে ঝুলিয়ে দাড়িয়ে রইল। কি যে ভাবছে।
‘কি ভাবছ? সিগারেট ধরিয়ে ফেল’Ñধবধবে সাদা শাট, কালো জিন্স পরে সাজিদের ঠিক পিঠের কাছে দাড়িয়ে আছে সাজিদ।
প্রথমটা চমকে গেলেও এক পলকে স্বাভাবিক হয়ে গেল সাজিদ, ‘ও হ্যা।’
গ্যাস লাইট বের করার জন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল বোতলটা। বোতলটা দেখেই হিংস্র একটা শব্দ বেরিয়ে এলো আরে জনের মুখ থেকে, ‘অ্যাসিড!’
সাজিদ লাফ দিয়ে পড়ল সাজিদের গায়ের ওপর। জাপটাজাপটিতে মিলেমিশে গেল দুই সাজিদ। কে কোন জন? শুধু একসময় শোনা গেল প্রবল একটা চিৎকারÑযন্ত্রনার চিৎকার, হাহাকারের চিৎকার।
*****
টসে জিতে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্যাপ্টেন। মিরপুর স্টেডিয়ামে যেন লোক ধরছে না। মহাউত্তেজিত কণ্ঠে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ শুরুর বর্ননা দিয়ে চলেছেন ধারভাষ্যকাররা।
বাংলাদেশী দুই ওপেনার বেরিয়ে এসেছেন ড্রেসিং রুম থেকে। ক্যামেরার দিকে চেয়ে হেলমেটের ফাক থেকে মৃদু মৃদু হাসছে সাজিদ।
হাসিটা দেখে একটু যেন গা গুলিয়ে উঠল ক্যাপ্টেনের। এ কোন সাজিদ?

ইত্তেফাক সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites