শনিবার, ১৬ জুলাই, ২০১১

চোখের জল শুকিয়ে গেছে


১৯৯০ সাল থেকে বিশ্বকাপ দেখি। বুঝে দেখি না, দেখি আর কী।
তখন ভালো ফুটবল, মন্দ ফুটবল; কিচ্ছু বুঝতাম না। হা করে গোল দেখতাম। ফলে আর্জেন্টিনা কি ফুটবল খেলে ফাইনালে উঠেছিল, ফাইনালে কেমন ফুটবল খেলেছিল মনে নেই। শুধু মনে আছে একজন মানুষের কান্না।
খুব কাছে পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ট্রফি ছোয়া হল না বলে একজন মহামানবের কান্নার কথা মনে আছে।
মনে আছে একা একা একটা দলকে ফাইনালে তুলে এনে বিচারকের পক্ষপাতের কাছে সব হারানোর একজন মানুষ হাউ মাউ করে কাঁদছেন। সেই আসলে আমার আর্জেন্টিনা বিষয়ক প্রথম শক্ত কোনো স্মৃতি। আর্জেন্টিনাকে আমি প্রথম ভালো করে চিনেছিলাম সেই মানুষটি, সেই ডিয়েগো ম্যারাডোনার কান্নার ভেতর দিয়ে।
কেন যেন কিছু না বুঝেই সেদিন ওই মানুষটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেদেছিলাম।
তারপর থেকে আর্জেন্টিনার জন্য কান্না অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে। তারপর থেকে সবসময় আমি আর্জেন্টিনার জন্য কাঁদি। আর এই লাতিন দেশটির ফুটবলারগুলোও এমন নিষ্ঠুর, সবাইকে কাদানোতেই যেন ওদের সবচেয়ে বড় শান্তি।
সেদিনের পর থেকে একটিবারও আর্জেন্টিনার হয়ে হাসার সুযোগ করে দেয়নি ওরা। আর্জেন্টিনার সুন্দর ফুটবল দেখে গর্ব করতে পেরেছি, আর্জেন্টিনার গোল উৎসব দেখে আনন্দে নেচে উঠতে পেরেছি, আর্জেন্টাইন কোনো খেলোয়াড়ের জাদু দেখে বুকটা ভরে গেছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাঁদতেই হয়েছে।
এর মধ্যে ১৯৯৩ সালে বাতিস্তুতারা একবার কোপা জিতেছিলেন। বলতে লজ্জা নেই, মফস্বলের ছেলে, তখন কোপা-টোপা বোঝার উপায় ছিল না। তখন ফুটবল মানে বিশ্বকাপ। আর বিশ্বকাপ মানে কান্না। ১৯৯৪ সালে ম্যারাডোনা কাঁদিয়েছেন, ১৯৯৮ সালে ওর্তেগা। ২০০২ সালে আর্জেন্টিনার ‘সর্বকালের সেরা দল’ প্রথম রাউন্ড থেকে মাথা নিচু করে বিদায় নিল; আমরা কাঁদলাম।
২০০৪ সালের কোপায় স্যাভিওলাদের দেখলাম ফাইনালে ব্রাজিলের সঙ্গে সমানে সমান টক্কর দিয়ে ২-২ গোলে ড্র করতে। আবার কাঁদতে হল পেনাল্টি শুটআউটে। দু বছর পর, ২০০৬ বিশ্বকাপে মনটাই ভরে গেল।
জার্মানিতে কী ফুটবলটাই না খেললো আর্জেন্টিনা! রিকেলমে, তেভেজ, রদ্রিগেজ, ক্যাম্বিয়াসো; সঙ্গে পিচ্চি একটা ছেলে লিওনেল মেসি। পুরো বিশ্বকাপটা চরকির মতো নিজেদের পায়ে নাচাচ্ছিল ওরা।
লাভ নেই। সেই কোয়ার্টার ফাইনালে এসে জার্মানির বিপক্ষে আবার কান্না। ২০০৭ সালে ভাবলাম বুঝি কান্নার শেষ হল। এবার কোপাটা অন্তত কেউ নিতে পারবে না। ব্রাজিল খোড়াতে খোড়াতে ফাইনালে উঠল। আর তুঙ্গফর্মের রিকেলমে ও মেসির কাছে ফাইনালের পথে সব দল স্রেফ উড়ে গেল।
ফাইনালে কি হল? ৩-০; ব্রাজিলের পক্ষে রেজাল্ট!
২০১০ বিশ্বকাপের আগে ভেবেছিলাম, এবার আর কান্না-টান্না লাগবে না। কোচ ম্যারাডোনা যেমন লেজে গোবরে করে ফেলেছেন, তাতে দল প্রথম পর্বই পার হতে পারবে না। কিন্তু ওই যে বললাম, ওদের মধ্যে একটা নিষ্ঠুরতা আছে। সেই নিষ্ঠুরতা প্রকাশের আগে কোত্থেকে যেন অমানুষিক একটা সৌন্দর্য এসে ভর করে আর্জেন্টাইনদের ওপর।
সেই সৌন্দর্যের জালে আবার বাধা পড়লাম। মেসি একটাও গোল পেলেন না; কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত বিশ্বকাপের সেরা আকর্ষন হয়ে রইলেন মেসি, সেরা দল আর্জেন্টিনা, সবচেয়ে আকর্ষনীয় কোচ ম্যারাডোনা!
তাদের পরিণতি আর মনে করিয়ে দেব!
আর কাঁদতে ইচ্ছে করে না। এবার কোপায় ভেবেছিলাম একই কথা। যে নোংরা ফুটবল প্রথম দু ম্যাচে খেললো, তাতে এদের জন্য চোখের জল ফেলা যায় না। কিন্তু কষ্ট তো দিতেই হবে। তাই কোস্টারিকার বিপক্ষে জাদু ভর করল। আমরা আর্জেন্টাইনদের নিষ্ঠুরতার কথা ভুলে গিয়ে আবার আশায় বুক বাঁধলাম।
মাঝ রাতে উঠে চোখে জল দিয়ে আবার স্বপ্ন দেখেতে বসলাম। পিছিয়ে পড়ল দুর্দান্ত খেলতে থাকা আর্জেন্টিনা। মেসির পাস থেকে হিগুয়েইন সমতা ফেরালেন। আর গোল হয় না। হিগুয়েইনের আচমকা শট বিস্ময়কর ভাবে ফেরায় উরুগুয়ের কিশোর গোলরক্ষক, মেসি শেষ মুহুর্তে ফিনিশ করতে ভুলে যান, হিগুয়েইনের আরেক শট ফেরে পোস্টের কোনায় লেগে। আমরা ভাবি, এমন ঝড়ো আক্রমনে গোল একসময় আসবেই। আসে না গোল। খেলা চলে যায় সেই পেনাল্টি শুট আউটে। ভয়ে বুক কাপে: ২০০৪, ২০০৬ সালের কথা মনে পড়ে যায়।
তারপরও আবার আশা পাই। মাচেরানো লাল কার্ড দেখায় আর্মব্যান্ড এখন মেসির হাতে। ভাবি, ঈশ্বর এই চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, এক ম্যারাডোনা তোদের কাদিয়ে শেষ করেছিল এক পর্ব। আরেক ম্যারাডোনার হাতে তোদের ভাগ্য দিলাম সপে।
হায় রে ভাগ্য। চার জন আর্জেন্টাইন পেনাল্টি শুটআউটে গোল করলেন। তারপরও কাঁদতে হল। কে কাঁদালেন।
আর্জেন্টিনায় এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার, জিপসি কার্লোস তেভেজ; আমাদের কার্তিলোজ।
কাঁদতেও যেন ভুলে গেছে আর্জেন্টাইনরা।
অভিশাপও দিতে পারি না।
এরা যে সব ফুটবল ঈশ্বরের উত্তরসুরী। ঈশ্বরের সন্তানদের কিভাবে অভিশাপ দেই!

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites