বিস্তর টাকার দরকার সাদেক আলমের। ‘বিস্তর’ বলে অবশ্য টাকার পরিমানটা ঠিক বোঝানো যাচ্ছে না। গুনে গুনে এক কোটি টাকা দরকার তার।
সমস্যাটা হল, এক কোটি টাকা কারো পকেটে তো দুরে থাক, মানি ব্যাগে কিংবা ড্রয়ারেও থাকে না। কে জানে, অতি বড়লোকদের ড্রয়ারে হয়ত থাকে। কিন্তু সাদেক আলম অতি বড়লোক না। সাদেক আলম আসলে মেজলোক, সেজলোকও না। সে নিতান্তই ছোটলোক।
ছোটলোক বলেই এক কোটি টাকার প্রয়োজন সাদেক আলমকে বিরাট একটা সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। তাদের ব্যাংকে এই পরিমান টাকা কোনোদিন ক্যাশ আসে না। ফলে ব্যাংক ডাকাতি-ফাকাতি করে লাভ নেই।
একটা উপায় ছিল। সাদেক আলমের বড় সাহেব কাসেম সাহেবের কিছু টাকা-পয়সা মেরে দিতে পারলে সে অনায়াসে এক কোটি টাকার মালিক হয়ে যেতে পারত। কাসেম সাহেব কয়েক শ কোটি টাকার মালিক বলে সে গল্প শুনেছে। কিন্তু কাসেম সাহেব যে এই কোটি কোটি টাকা কই রাখেন, সেটা সাদেক এখনও আবিস্কার করে উঠতে পারেনি। তাই কাসেম সাহেবের টাকাটা আপাতত লোপাট করা হচ্ছে না।
হচ্ছে না, বললে তো আর টাকার সমস্যা সমাধান হয় না। বরং প্রতিদিন সকালে উঠেই সাদেকের মনে হচ্ছে, আজ অবশ্যই ওই এক কোটি টাকা জোগাড় করা দরকার। পরিমানটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আজ সকালে সাদেক আবার ফোন করেছিল কিনিকটায়,
‘ভাই, এক কোটি টাকার কমে কি কোনোভাবেই কাজটা হয় না?’
‘কে? কে বলছিলেন!’Ñওপাশ থেকে এক মহিলা কর্কশ কণ্ঠে প্রায় চিৎকার করে উঠেছে। খুন করার অভ্যেস করে ফেলতে পারলে, সাদেক নিশ্চিত এই মহিলাকে খুন করে ফেলত।
তারপরও মেজাজটা ঠাণ্ডা করে জবাব দিয়েছে, ‘আমি। আমি সাদেক আলম। ওই যে আপনাদের বিজ্ঞাপনটার ব্যাপারে...’
‘ওহ। সেই বিজ্ঞাপন? সেটা তো আমরা বিজ্ঞাপনেই পরিস্কার করে বলে দিয়েছি। এক কোটি টাকার নিচে কিছুই হবে না। ভাই শোনেন, এসব খয়রাতী লোকের কাজ না।’
‘ও আচ্ছা!’Ñবলে হতাশ হয়ে লাইনটা কেটে দিল সাদেক।
আর কোনো উপায় সে দেখতে পাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত আর সবার মত মরেই যেতে হবে সাদেক আলমকেও! বড় আশা করেছিল এক কোটি টাকা জোগাড় করে অমর হবে সে। আহা রে!
দৈনিক ভূমিকম্প টাইপের একটা পত্রিকায় ছাপা হওয়া একটা বিজ্ঞাপনই আসলে সাদেক আলমকে স্বপ্নটা দেখিয়েছিল। শুধু স্বপ্ন দেখিয়েছিল বলাটা ভুল হবে। সাদেক আলমকে ওই বিজ্ঞাপনটাই আজ এরকম লোভী করে তুলেছে।
এমনিতে সাদেক আলম ছা-পোষা মানুষ। মানে, ছা-পোষা মানুষের যেমন বর্ননা গল্পে থাকে, সাদেক আলম ঠিক সেরকম মানুষ। সকাল আটটায় বেরিয়ে সাড়ে দশটায় অফিসে পৌছায়, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বড় সাহেবের গালি খায়, বিকেল বেলা আবারও বাসে লোকেদের ধাক্কা খায় আর রাতে বাসায় ফিরে বড় আপার ধ্যাতানি খায়।
এই জীবন নিয়ে সাদেকের কোনো আফসোস ছিল না। বরং এই জীবনটাই টেনে আরেকটু লম্বা করতে পারলে খুশি হত সে। সেই সুযোগটাই পেয়ে গেল বিজ্ঞাপনটায়!
এত্তা বড় বড় ল্যাপটানো অরে লেখাÑঅমর হউন! তারপর অনেক ইদং করে বর্ননা করে হয়েছে, অমর হওয়ার ঔষধ বাংলাদেশে আমদানী করা একমাত্র সংস্থার বিজ্ঞাপনটা। এর আগে কোন দেশের কোন বড় লোক, শিল্পপতি, চিত্রতারকা এই ওষুধ ব্যবহার করেছেন, সে বর্ননা দেওয়া আছে। আর এক্কেবারে শেষ বেলায় যেয়ে বলা হয়েছে আসল কথাটাÑ
তিন দফায় এই ওষুধ ব্যবহার করিতে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৯৬ ল ৮৪ হাজার টাকা খরচ হইবে। হাসপাতালে থাকাসহ অন্যান্য খাতে আরও প্রায় চার ল টাকা খরচ হইবে।
হেহ! এতো কথার এক কথা, অমর হতে সাদেক আলমের এখন এক কোটি টাকা লাগবে। দু চার হাজার বেশি লাগলে সমস্যা নেই। সাদেক আলমের অ্যাকাউন্টে সাত হাজার কত টাকা জানি আছে। কিন্তু আসলটাই তো হল না। সেই এক কোটি টাকা!
আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল সাদেক। ঠিক এই সময় হঠাৎ মনে পড়ে গেল মোতালিব মামার কথা। মনে পড়তেই রাগে নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করল। অ্যাতো দিন ধরে কেন কথাটা মনে পড়েনি!
মোতালিব মামা মোটেও সাদেকের আপন মামা না। এমনকি চাচাতো, মামাতো বা খালাতো মামাও না। সাদেক আলমের মায়ের ফুফাতো ভাই এই মোতালিব মামা। কি করে যেন ফেপে ফুলে বিরাট বড়লোক হয়েছেন। এখন কী যেন বলে. ওই যে একটা মটর কোম্পানি না কিসের যেন মালিক হয়ে গেছেন। মোতালিব মামার তিন কুলে কেউ নেই, সাদেক আর তার আপা ছাড়া।
মোতালিব মামার বাসায় গেলেই তিনি প্যাকেটে এক কোটি টাকা ভরে সাদেকের হাতে তুলে দেবেন. এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। হাড় কিপ্পিন মোতালিব মামার হাত থেকে একটা টাকা বের করা মুশকিল।
থাকেন একটা ভাড়া বাড়িতেÑদুই তলায় দুই রুমের বাসা। বেশি খরচ হবে বলে স্থায়ী কাজের লোক পর্যন্ত রাখেন না। কাজের লোক বলতে একটা বুয়া। দুপুরে এসে দুই বেলার মত রান্না করে দিয়ে যায়। সকালে পাউরুটি আর কলা দিয়ে কাজ সারেন তিনি।
সবসময় যেমন হয়, এবারও সাদেক আলমকে দেখে মহাবিরক্ত হলেন মোতালিব মামা, ‘কী, মরছি নাকি সেই খোজ নিতি আইছো? এহোনো মরিনাই। আর মরলিও তুমি কিছু পাবা না। সব দিয়ে যাবো তোমার আপারে। তোমার মত অপগণ্ডরে কিছু দিয়ে লাভ নেই।’
সাদেক মহাবিনয়ী, ‘আপনার টাকার জন্য আসিনাই মামা। আপার বাসায় থাকার একটু সমস্যা হচ্ছে। কয়দিন পরই চলে যাবো।’
‘থাকো। কিন্তু খাওয়ার খরচ দিতি পারব না। বাজার-টাজার করতে হবে।’
সাদেক সবকিছুতেই রাজী। তার মাথায় দারুণ একটা প্লান আছে। প্লানটা কঠিন কিছু না। মোতালিব মামার একটা চেক জাল করে ফেলা। সহজে ধরা খাওয়ার চান্স নাই। কারণ, মামা ব্যাংকে খুব একটা যোগাযোগ রাখেন না। মাঝে মাঝে শুধু টাকা জমা দেন। সমস্যা একটাই, একবারে কোনো ব্যাংক থেকে এতো টাকা ঝামেলা ছাড়া তোলা যাবে কিনা।
অবশ্য কোনো ঝামেলাই করতে হল না সাদেককে। তার আগেই ভাগ্য বদলে দেওয়া একটা কাহজ হাতে পেয়ে গেল সে। এমন কিছু না, একটা জীবন বীমার কাগজ। মামার বিছানার তলায় হাতাতে গিয়ে পেয়ে গেল সাদেক।
আর কাগজটাই চোখ খুলে দিল তার। দেড় কোটি টাকার একটা জীবন বীমা আছে মোতালিব মামার। মামা মারা গেলে টাকাটা পাবে তার নমিনি। আর নমিনিটা কে? খোদ সাদেক আলম!
এবার সাদেক বুঝল, মামা কেন বছর দুয়েক আড়ে তার পাসপোর্ট সাইজের ছবি চেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ‘কি করতে হবে’ বুঝে ফেললো সেÑমামাকে সরিওেয় দিতে হবে।
কিন্তু ‘সরিয়ে দিতে হবে’ বললেই তো আর হল না। পুলিশ আর ইন্সুউরেন্স কোম্পানির লোকজনের মনে সন্দেহ না তৈরি করে সরাতে হবে। কাজটা সোজা না। গত এক সপ্তাহ ধরে কাজটা করার উপায় ভাবছে সাদেক। উপায় বের করার জন্য সে একটা পর একটা ইংরেজী সিনেমাও দেখা শুরু করল। ইংরেজী সিনেমাগুলোয় খুন করার দারুণ সব উপায় দেখানো হয়।
বললে বিশ্বাস করবেন না, ওই একটা সিনেমা থেকেই আইডিয়াটা পেয়ে গেল সাদেক। খুবই সোজা আইডিয়া। কোনো ভারী অস্ত্রপাতি লাগবে না, বিষ লাগবে না। লাগবে স্রেফ একটা হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ। শুনতে যতই খটমটে নাম হোক, আসলে ওই যে স্রেফ ইনজেকশন করার সিরিঞ্জ।
অবশেষে দিনটা পেয়ে গেল সাদেক।
‘শরীর কেমন খারাপ লাগতিছে’ বলে সকাল সকাল শুয়ে পড়েছিলেন মোতালিব সাহেব। সাদেকও ‘ডাক্তার ডাইকে আনি’ বলে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় পাশের ফাটের মতিন সাহেবকে বলে গেল, ‘মামার শরীর খারাপ; একটু খেয়াল রাখবেন।’ ফিরে এল পাঁচ টাকা দামের একটা সিরিঞ্জ কিনে নিয়ে।
মামার রুমে ঢুকে ডাক দিল, ‘মামা। ও মামা!’
‘হু’
‘ডাক্তার কইুছে পরে আসবে। একটা ইনজেকশন করে দিতি কইলো।’
‘ইনজেকশন করবে কেডা?’
‘আমি পারি তো। প্যারামেডিকের টেনিং নেলাম না সেবার?’
মামা আর কথা বাড়ালেন না। হাত বাড়িয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন। সিরিঞ্জটা বের করে স্রেফ পাঁচ সিসি বাতাস টেনে নিল সাদেক। আর কিচ্ছু লাগবে না। এবার মামার হাত ধরে শিরাটা খুজে বের করল। কাপা হাতে জোর করে শিরায় ঠেলে দিল বাতাস। এবার যা করার বাতাসই করবে।
তাই করল। পনেরো মিনিটের মধ্যে ‘বুকে ব্যাথা, বুকে ব্যাথা’ বলে চিৎকার শুরু করলেন মোতালিব মামা। সাদেকও ‘ডাক্তার, ডাক্তার! পানি’ বরে চিৎকার শুরু করল। প্রতিবেশীরা ছুটে এলো এবং ‘হƒদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে’ মারা গেলেন মোতালিব মামা।
সাদেক আলম এখন একজন অমর মানুষ। সে যেমন ভেবেছিল, তার চেয়েও অনেক নিরাপদে সব ঝামেলা চুকেছে। সময় মতই ইন্সুরেন্স কোম্পানি টাকা দিয়ে দিয়েছে। সাদেক তিন দফায় অমরত্বের ওষুধ নিয়েছে শরীরে। এখন আর স্বাভাবিক কোনো কারণে তার মৃত্যু নেই।
সবচেয়ে বড় কথা, মোতালিব মামা মরার পর সাদেক আবিস্কার করেছে, এখন সে রীতিমত বড়লোক মানুষ। মামা আপার আর তার জন্য সমান সম্পদই রেখে গেছেন। এখন সে ইচ্ছে করলে আরও দু এক জন মানুষকে অমর করতে পারে। সাদেকের আপাতত একজন মানুষকে অমর করার পরিকল্পনা আছেÑতার বৌ।
হ্যা, সাদেক বিয়েও করছে। আজই ঘটক আসার কথা। এই জন্য শুক্বুরবার বিকেলে কোথাও যায়নি সাদেক। ধবধবে সাদা একটা পাঞ্জাবী পরে বাসায় বসে আছে।
কলিংবেল বেজে উঠতেই বুঝল, ঘটক, মানে তার এক চাচার শালা এসে গেছেন। দরজা খুলে অবশ্য একটু অবাক হল সাদেক। ঘটকের তো পুলিশের পোশাক পরে আসার কথা না।
এই ভদ্রলোকের পরনে পুলিশের পোশাক। বুকে কি সব তারা-টারা লাগানো। পকেটের ওপর ব্যাচে লেখা, সাবেত আলী।
পুলিশ হলেও সাবেত আলী লোকটা খারাপ না। হতভম্ব সাদেককে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকেই বললেন,
‘মামার টাকায় দিন তাহলে ভালোই কাটছে সাদেক সাহেব?’
‘হ্যা, মানে, তা তো বটে।’
‘কিন্তু খুনটা তো না করলেও পারতেন। ক দিন পর তো এমনিতেই টাকাটা পেতেন।’
‘খুন! হাঃ হাঃ! কি বলেন আপনি! মাথা ঠিক আছে?’
‘মাথায় কোনো সমস্যা না। বুদ্ধিটা ভালোই করেছিলেন। কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ধরা পড়ে গেছেন।’
‘পোস্টমর্টেম রিপোর্ট! সে তো কবেই আসছে। তাতে তো ডাক্তাররা কিচ্ছু পায়নি। সেই রিপোর্ট দেখেই তো ইন্সুরেন্স কোম্পানি টাকা দিল।’
‘সব সত্যি। কিন্তু ওই কিছু না পাওয়াটাই তো সমস্যা। কিছু একটা যে পেতে হত সাদেক সাহেব।’
‘কি পেতে হত?’
‘আপনি যে ইনজেকশন করেছিলেন, সেটার নমুনা তো মোতালিব সাহেবের রক্তে থাকার কথা।’
‘ইনজেকশন!’
‘‘হ্যা। এখানেই ভুলটা করেছিলেন। মোতালিব সাহেবের প্রতিবেশি মতিন সাহেবকে আপনি বলেছিলেন, ‘ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি।’ আমরাও পরে সেই সিরিঞ্জটা খাটের নিচে পেয়েছি। স্রেফ বাতাস শিরায় পাঠিয়ে দিলে যে কি হয়, ডাক্তাররা তো তা জানে। ফলে, আপনি ধরা পড়ে গেলেন সাদেক সাহেব’’।
সরকার পরে উকিল সাদেক আলমের ফাঁসি চেয়েছিল। কিন্তু আদালত সে কথা রাখেননি। একটু মুচকি হেসে বিচারক তার রায় শুনিয়েছিলেনÑ
সকল স্বাী স্বা ও উপস্থিত প্রমানাদি বিচার করে এই আদালত সিদ্ধান্তে পৌছেছে যে, আসামী সাদেক আলম সত্যিকারের অপরাধী।... আদালত তাকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করছে। এর আগ পর্যন্ত প্রচলিত যাবজ্জীবন নয়। অমর সাদেক আলম যতদিন বেচে থাকবেন, ততদিনই তাকে কারদণ্ড ভোগ করতে হবে।
প্রথম আলো বন্ধুসভার সাহিত্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিত
শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০১১
অমর মানুষ
শুক্রবার, জুন ২৪, ২০১১
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
Facebook comments for blogger brought to you by AllBlogTools.com