বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন, ২০১১

প্রফেসর ইউনুস এবং ভাবমূর্তি

অনেকটা সেই তলসিমা নাসরিন কান্ডের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যেহেতু তসলিমা নাসরিনের বিরোধিতা করছিল ইসলামী দলগুলো; তাই যৌক্তিক সমালোচনা করলেও তসলিমা নাসরিন বিরোধী সকলকে ‘জামাতি’ বলে গালি দেওয়া শুরু হয়েছিল তখন।
এখন সমস্যাটা প্রফেসর ইউনুসকে নিয়ে। শান্তিতে নোবেলজয়ী বাংলাদেশী এই অর্থনীতিবিদের এখন কোনো যৌক্তিক সমালোচনাও কেউ আর শুনতে রাজী নন। শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার শিকার হওয়ায় ভদ্রলোকের প্রতি সহানুভূতি এখন তুঙ্গে। ফলে যেই তার সমালোচনা করছেন, তাকে ‘আওয়ামী দালাল’ বলে গালি দেওয়ার একটা প্রবনতা তৈরি হয়েছে।
এই ঝুকিটা মাথায় নিয়েই লেখাটা লিখছি।তবে শুরুতেই শপথ করে নিচ্ছি যে, আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি, প্রফেসর ইউনুস প্রতিহিংসার শিকার। নইলে দুই দশক আগে করা দুর্নীতি-অনিয়মের সাজা এখন এসে মিলত না।
আমি ইউনুস ইস্যুতে মূলত তিনটি পয়েন্ট আলোচনা করতে চাই।
পয়েন্ট ১: প্রফেসর ইউনুস অনিয়ম করেছেন, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে লাভ করেননি। এই কথাটা একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখতে চাই।
পয়েন্ট ২: প্রফেসর ইউনুস নোবেল পেয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়িয়েছেন। ফলে তার সমালোচনা করা যাবে না। এই কথাটার বিরোধিতা করতে চাই।
পয়েন্ট ৩: প্রফেসর ইউনুস ইস্যুতে বিদেশী কুটনৈতিক তৎপরতাকে যেভাবে স্বাগত জানানো হল, সেটা বুঝতে চাই।

১।
প্রথম কথা হল, পত্রিকাগুলো (বিশেষ করে প্রথম আলো) বলছে, প্রফেসর ইউনুস অনিয়ম করেছেন, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে লাভ করেননি। দলিল অনুযায়ী ঘটনা সত্যি। কারণ, তিনি এই অনিয়ম থেকে পাওয়া কোনো লাভ নিজের নামে কোনো অ্যাকাউন্টে জমা করেননি।
এখন কথা হল, আজকের দিনে কেউ সেটা করেন কিনা। এই মানদন্ডে বিচার করলে তারেক রহমান বা আকবর সোবহান সাহেবও দুর্নীতির অভিযোগ থেকে মাফ পেয়ে যাবেন। কোনো দুর্নীতিন অর্থ সরাসরি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও জমা হয় না। এগুলো হয় বেনামে। এখন আমরা দেখি, প্রফেসর ইউনুস ‘বেনামে’ এই সুবিধেটা নিয়েছেন কি না।
ইউনুস সাহেব গ্রামীন ব্যাংকের ফান্ড রিভলব করে (সোজা বাংলায় সরিয়ে) ৪৬টি লাভজনক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন; যার মধ্যে গ্রামীন ফোনের উল্লেখযোগ্য অংশও আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো করতে গিয়ে একটি দাতা সংস্থার (নোরাড) অর্থ ও বাকিসব ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋনের অর্থ গ্রামীন ব্যাংকের ফান্ড থেকে সরানো হয়েছে। মজার ব্যাপার কী জানেন, এর একটি প্রতিষ্ঠানও কিন্তু গ্রামীন ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ না।
আজ ইউনুস গ্রামীন ব্যাংক থেকে সরে গেলেন; ফলে তার হাতে রইল শুধু লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো। বলা হচ্ছে, ইউনুস দুর্নীতি করেছেন, তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে লাভ করেননি। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড় ব্যক্তিগত লাভ আর কী হতে পারে? গ্রামীন ব্যাংক থেকে সরে যাওয়ার পর ইউনুসের হাতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোটি কোটি টাকার মালিকানা রইল। সেটাকে ব্যক্তিগত লাভ বলবেন না!

২।
নোবেল প্রাপ্ত বলে ইউনুস সাহেবের সমালোচনা বা তার কোনো সাজা বৈধ নয়; এমন একটা বাতাবরন তৈরি হয়েছে। কিন্তু নোবেল কি আসলে এ ধরণের কোনো সনদপত্র? যা পেলে তাকে আমাদের সৎ বলে ধরেই নিতে হবে।
তাহলে একটু অন্যান্য সকল নোবেল বিজয়ীর নামও এই তালিকায় লিখে দেখেন প্লিজ। অনেকের নাম দেখে ঘেন্নায় মুখ বাকা হয়ে যাবে। নোবেল যে কোনো ভাবেই চরিত্রর সত্যায়নপত্র নয়, তা নোবেলপ্রাপ্তদের তালিকা দেখলেই বুঝতে পারবেন। নোবেলপ্রাপ্তদের তালিকায় খুনী-ধর্ষকও আছে। নোবেল (শান্তি) প্রাপ্তদের তালিকায় মাদার তেরেসা, নেলসন ম্যান্ডেলার মতো শ্রদ্ধেয় মানুষ যেমন আছেন; তেমনই আছেন কসাই নামে খ্যাত জিমি কার্টার, হেনরী কিসিঞ্জার, আফগানিস্তান-লিবিয়ার রক্ত মাখানো হাতের বারাক ওবামা, আছেন ফিলিস্তিনিদের ওপর রোলার চালালো আইজ্যাক রবিন। এমন আরও অনেকের নাম খুজলে বের হবে।
তাদের কারো সমালোচনার ক্ষেত্রে আলফ্রেড নোবেল সাহেবের পদকটি বাধা হয়ে দাড়ায়নি। এমনকি রবীন্দ্রনাথের কোনো অসৎ কাজও যদি আজ বেরিয়ে আসে, সেটাও নোবেলের কারনে আলোচনার অযোগ্য হয়ে যাবে না।

৩।
প্রফেসর ইউনুস ইস্যুতে বিভিন্ন দূতাবাস আমাদের রাষ্ট্রকে যেভাবে ধমকা-ধমকি করল, সেটা আমাকে বিস্মিত করেছে। ১/১১-এর পর এমন ধমকাধমকি দেখেছিলাম। তাতে আমাদের বুদ্ধিজীবিরা তাৎক্ষনিক প্রতিবাদ না করলেও, পরে সুসময় দেখে বলেছেন, এতে আমাদের মান ক্ষুন্ন হয়েছে।
মিলটা এখানে যে, তখনও প্রথম আলো এসব ধমকাধমকিতে উৎসাহ দিয়েছিল। এবারও দিয়েছে। এবং এবারও আমাদের বুদ্ধিজীবিদের কারো এখনও মনে হচ্ছে না যে, এই ধমক আওয়ামী লিগকে নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে। এই ধমকের অর্থ এই যে, ‘আমার সঙ্গে যার স্বার্থ জড়িত, তাকে কিছু বলার সাহস বাংলাদেশের মতো পুচকে দেশ কোত্থেকে পায়!’

এসবের পরে আপনার প্রশ্ন হতে পারে, ইউনুস তাহলে নোবেলটা পেলেন কেন? কিসিঞ্জার, কার্টার, ওবামা; সবারই নোবেল পাওয়ার একটা প্রেক্ষিত ছিল; কোনো না কোনো ভাবে তারা ক্ষমতার কেন্দ্রকে (সোজা ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রকে) বাচিয়ে দিয়েছিলেন। ইউনুস এমন কি করলেন, যাতে তাকে নোবেল দেওয়া হল।
এক্ষেত্রে একটু তাত্ত্বিক জায়গাটা ব্যাখ্যা করা দরকার। ইউনুস সত্যিই শান্তি রক্ষায় অবদান রেখেছেন। কাদের শান্তি? যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক বৈশ্বিক প্রশাসনের শান্তি রক্ষা করেছেন তিনি। এমন একটা সময়ে (আশির দশকের শেষ দিক থেকে) ইউনুস ক্ষুদ্রঋন তত্ত্ব নিয়ে আবির্ভূত হলেন, যখন ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে কেবল ধ্বস নামতে শুরু করেছে।
বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তির লোকজনের ক্রয় ক্ষমতা দ্রুত কমে যেতে থাকায়, বাজার ছোট হয়ে আসছিল। এই বাজার ছোট হয়ে যাওয়ার দুটো বিপদ। এক. এতে সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতি। দুই. তৃতীয় বিশ্বে দারিদ্র মারাত্মক চেহারা নিলে ক্ষোভের বহিপ্রকাশের সম্ভাবনা।
এক ক্ষুদ্রঋন যেভাবে প্রান্তিক মানুষের হাতে কিছু টাকা পৌছে দিল, তাতে দুই সমস্যার সমাধানই ভোজবাজির মতো হতে শুরু করল। নব্বইয়ের শেষ দিকে এসে প্রথম বিশ্ব বিস্ময়ের সঙ্গে আবিস্কার করল, তারা কোনো কিছু না করার পরও দারুণভাবে বাজার টিকে গেছে। এই কাজটি করায়, অবশ্যই ইউনুস সাহেব নোবেল পুরস্কারের বিবেচনায় আসতে পারেন।

এসব বড় কথা বড়দের জন্য তোলা থাক। আমরা আপাতত দেখছি, ইউনুস সাহেবের জন্য কান্নাকাটি না করলেও চলবে। শেখ হাসিনা মধ্যবিত্ত ঝগড়াটে মহিলার মতো আচরণ করে ইউনুস সাহেবের সত্যিকারের কোনো ক্ষতি করতে পারেননি। আর্থিক ও জনপ্রিয়তার বিচারে ইউনুস সাহেবের লাভই হয়েছে।
নোবেল জেয়ের আগে পরে ইউনুস সাহেব কখনোই দেশে প্রবল জনপ্রিয়দের একজন ছিলেন না। সেনা সমর্থিত সরকারের সমর্থনে রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করেছিলেন। তাতে জনগনের ব্যপক বিরুপ প্রতিক্রিয়া টের পেয়ে আর এগোননি। নোবেল পাওয়ার পরও জনপ্রিয়তা এমন কিছু বাড়েনি। অন্তত লাখ লাখ সদস্যের গ্রামীন ব্যাংক থাকার পরও দেশে আমরা ‘নোবেল বিজয় উল্লাস’ দেখিনি। কিন্তু ভদ্রলোকের বিপক্ষে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া মাত্রই তিনি এখন মারাত্মক জনপ্রিয়।
আমি নিশ্চিত, এবার কেয়ার টেকার সরকার এলে আবার তিনি যখন দল করার উদ্যোগ নেবেন ‘বিপ্লবী জনতা’ তার পাশে থাকবে। অল ক্রেডিট গোস টু শেখ হাসিনাস ভিনডিকটিভ মেন্টালিটি।

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites