বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১১

এ কী আজব কারখানা!!!!

আমি মানুষ হিসেবে খানিটা উটপাখি প্রকৃতির। কোনো সমস্যা দেখলে মুখ গুজে ফেলে বেচে যাওয়ার চেষ্টা করি। 
সমস্যার খবর শুনে নিজেকে বলি, যাক আমার তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। রমনা বটমূলে বোমা ফাটে, হুমায়ুন আজাদ মারা যান, বিডিআরে গোলাগুলি হয়; আমি নিজেকে বলি, আমি তো বেঁচে আছি। আহলে আমার এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী?
এই বাউলদের ব্যাপারটাতেও তাই করছিলাম। পত্রিকায় দেখলাম, বাউলদের ধরে নিয়ে চুল, গোফ কেটে দেওয়া হয়েছে। আমি ভাবলাম, তা কাটুক, আমার মস্তক তো অক্ষত আছে। অতএব আমি শান্তিতেই ছিলাম।
শান্তিতে থাকতে দিল না একটা ছবি। ছবিটা কোথায় দেখলাম? মনে পড়ছে না। এক জায়গায় কয়েকজন বাউল বসে আছেন।অত্যন্ত অপরিশিলিত হাতে তাদের চুলগুলো প্রায় মুন্ডন করে দেওয়া হয়েছে। চোখে মুখে দারুন একটা অসহায়ত্ব। সবচেয়ে বড় কথা মানুষগুলোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে, বিস্ময়ে অনড় হয়ে গেছেন।
হঠাৎ মনে হল, ছবির ভেতর থেকেই যেন কে বলে উঠলেন, এ কী আজব কারখানা!
আমি আর পারলাম না। আর উটপাখি হয়ে থাকা হল না। এবার কাঁদতেই হল। এই অসহায়, সরল মানুষগুলোর জন্য এবার কাঁদতেই হল।
বাউল, বৈষ্ণব, সুফিদের নিয়ে আমার না আছে কোনো পড়াশোনা; না আছে বিন্দু মাত্র জ্ঞান। শুধু আধুনিক শব্দযন্ত্রে গোটাকতক গান শুনেছি মাত্র। সে গানের মর্ম খুব বুঝে, এমন দাবিও করা চলে না।
কিচ্ছু না বুঝেও বাউলদের ব্যাপারে, একটা ধারণা ছিল আমার; এই মানুষগুলোর বুঝি কোনো শত্রু নেই। শত্রু থাকবে কেন? আমি তো চোখের সামনে দেখি মানুষগুলো গান গেয়ে, সহজিয়া জীবন যাপন করে, নিজের মতো করে স্রষ্ঠার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে দিন কাটাচ্ছে।
আমি জানি না ইসলাম বা হিন্দু ধর্মের সঙ্গে সুফিবাদ, বাউলতত্ত্ব বা বৈষ্ণবমতের কি লড়াই। আমি জানি না, কোথায় তারা ধর্মবিরোধী। বরং আমার তো মনে হত, আমাদের মতো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের পেছনে ছোটা লোকেদের চেয়ে স্রষ্ঠার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক
টাই বেশি গাড়!
ধর্মগুলো যা বলে, বাউলরা তো তেমই সৎ আর সহজ জীবন যাপন করেন। বাউলরা তো কারো ক্ষতি করেন না। বাউলরা কাউকে আক্রমন করেন না। বাউলরা মসজিদ-মন্দিরে লড়াই বাধিয়ে দেন না। তাহলে এদের কেন শত্রু থাকবে!
হায়রে উট পাখি। তোমার বোঝা এই দুনিয়ার বাইরে অনেক কিছু আছে। এখানে অজাতশত্রুও হিংসার শিকার হয়। যে মানুষগুলো মানুষকে ভজন করতে বলে, যে মানুষগুলো সুপথে চলতে বলে; কারা যেন তাদের ধরে নিয়ে চুল কেটে দেয়।
কেন এই তৎপরতা, তার ধর্মী য় ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। আমি সে ব্যাখ্যায় না গিয়েই বলি, এ বড় অন্যায়। একজন মানুষকে তার মত মতো জীবন যাপনে কেউই বাধা দেওয়ার অধিকার রাখে না। তারওপর বাউলের মতো মানুষকে তো নয়ই।
আমার এই পলায়নপর বোধ থেকেই আমি বুঝতে পারি, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ হওয়া দরকার। এই ব্লগেই দেখেছি, অনেকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখেছেন। সবাইকে শ্রদ্ধা। এবং সবার কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, আসুন এই অন্যায়ের প্রিতিবাদ করি।
একটি লিংক পেয়েছি। এখানে অনেকে সই করছেন প্রধানমন্ত্রীর বরাবর আবেদন পাঠাবেন বলে। এটাতে সবাই মিলে অংশ নেওয়া যেতে পারে।
সবশেষে বলি, আমার এক বন্ধু ফেসবুকে ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছেন; সবাই মিলে চুল বড় করি, দেখি ক জনের চুল কাটতে পারে। এও মন্দ নয়; অন্তত প্রতিবাদ তো করা হল।

নোট: প্রথম আলো ব্লগে লেখাটি ছাপা হওয়ার পর অনেক আলোচনা হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য কিছু


সজীব মোহন্ত১৮ এপ্রিল ২০১১, ১৬:০৫
কি হবে সাইন দিয়ে........না হয় প্রধানমন্ত্রির কাছে আবেদন করলেন..........প্রধানমন্ত্রি আশ্বাস দিবেন এ ধরনের অন্যায় আর কখনই ঘটবে না.........কিছুদিন এ নিযে টকশো হবে পত্রিকায় লেখালেখি হবে........তারপর যেই লাউ সেই কদু।
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়১৮ এপ্রিল ২০১১, ২৩:৩৯
সজীব, আপনার সঙ্গে পুরোপুরি একমত। আমিও জানি, কিচ্ছুই হবে না। কিন্তু এটা আমাদের অস্তিত্বের জানান দেওয়ার প্রশ্ন। 
এ প্রসঙ্গে আমি একটু অন্য একটা কথা বলি? 
আমরা কেন যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবী করি? আমরা জানি, সত্যিকার অর্থে যুদ্ধাপরাধীর বিচার আওয়ামী লিগ করবে না। এখনও যা করছে, সেটা বিচার নয়, অন্য কিছু। তারপরও আমরা দাবী জানাতে থাকবো, এবং যা কিছু অল্প হচ্ছে তাকেও সমর্থন দেব। কারণ এই কাজগুলো যে মুহুর্তে আমরা সবাই বন্ধ করে দেব, আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে। মনে হবে এই দেশে একাত্তরের নৃশংসতা মনে রাখা একটি লোকও আর অবশিষ্ট নেই। তাই আমরা দাবী জানাই। 
ঠিক তেমনই আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রী সব জেনেও চুপ করে থাকবেন। তার দলীয় নেতাদের সম্পৃক্ততাকে এড়িয়ে যাবেন। মানুষের মাথা কাটা গেলে যে সরকারের কিছু যায় আসে না, সামান্য ‘চুল’ কাটা নিয়ে তারা বিচলিত হবেন না। 
তারপরও আমরা এই কাজটি করে যাবো, আমরা বারবার স্মারকলিপি পাঠাবো। বারবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে থাকবো। 
একদিন ইতিহাস অন্তত স্বীকার করবে, আমরা সময়ের দাবি মিটিয়েছিলাম। আমরা টিকিয়ে রেখেছিলাম একটি প্রগতিশীল চিন্তা। 
*এই ‘আমরা’ মানে আমি বা অন্য কেউ নয়, আমি-আপনি সকলে।

শ‍হীদুল ইসলাম প্রামানিক১৮ এপ্রিল ২০১১, ১৬:০৩
বাউলদের দোষ নাই তবে দোষটা হয়তো গাঁজাখোরদের।
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়১৯ এপ্রিল ২০১১, ০০:২২
প্রামানিক ভাইয়ের কথা বেশ ইঙ্গিতপূর্ন। এই বাউলরা ‘গাজাখোর’ বা মাদকসেবী ছিলেন, এমন খবর যদি আপনার কাছে থেকে থাকে; তাহলে তাদের প্রতি আমার ব্যক্তিগত সহানুভূতি কমে যাবে। কিন্তু তাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, এরপরও আমি তার প্রতিবাদ করবো।
কারণ-১: কেউ মাদকসেবী হলেও তার বিচার করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কয়েকজন আওয়ামী কর্মী আর গোড়া ধর্মনেতার দায়িত্ব নয়। এ ধরণের বিচার কাজ এর আগে যারাই নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন, তারা পরে দৈত্যে পরিণত হয়েছেন, বলে ইতিহাস স্বাক্ষ দেয়। আমাদের মনে আছে এই পদ্ধতিতে একজন বাংলা ভাইয়ের উত্থানের কথা্। তার কর্মকান্ডও শুরুতে সমাজবিরোধীদের বিচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন রাষ্ট্রও তাকে উৎসাহ দিয়েছে। পরে আমরা দেখেছি, স্বনিয়োজিত এই ধরণের বিচারক কি ভয়ঙ্কর চেহারা ধারণ করে।
কারণ-২: একজন বাউল, তিনি মাদকসেবী হলেও তার চুল কাটা মানে পুরো বাউল সমাজকে আহত করা। একজন সন্নাসীর দাড়ি বা একজন আলেমের টুপি যেমন স্পর্শ করা একটি জাতির জন্য অবমাননাকর, বাউলদের ক্ষেত্রেও তাই। ফলে ব্যক্তিগত অপরাধে কারো গোষ্ঠীগত প্রতীকে হামলা চলতে পারে না।
তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই বাউলরা মাদকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সাধুসঙ্গ যে সব বাউল করেন, তারা নেশা থেকে শতহস্ত দূরে থাকেন। তাদের কাছে স্রষ্ঠার সঙ্গে প্রেমই নেশা।
আর প্রামানিক ভাই যদি বাউল বলেই ‘গাজাখোর’ ধরে নেন; সেটা ভুল হবে। কারণ দাড়ি-টুপি মানেই জঙ্গিবাদ নয়, পূজারী মানেই শিবসেনা নয়, তেমনই বাউল বেশ মানেই নেশাখোর না। বরং বাউলরা বলতে পারেন, ‘তোমরা যে জামা-প্যান্ট পরে ইয়াবা, ফেনসিডিল খাও। তাহলে সবার জামা-প্যান্ট কি আমরা খুলে নেব!’

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites