বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১১

আমাদের বিশ্বকাপ-তামামি

বিশ্বকাপ শেষ। কাল দেখলাম,রাস্তার লাল-নীল বাতিগুলো খোলা শুরু হয়ে গেছে।মানে, বাসি বিয়ের খাওয়াও শেষ। এখন পড়ে আছে শুধু ডাস্টবিনের গন্ধ আর দেনা-পাওনা মেটানোর পালা। আমরাও এক কাজ করি কেন? বিশ্বকাপের খেরো খাতাটা মিলিয়ে নেই?
দু চারটে পয়েন্ট ‘মাইনাস’ গেছে, তবে ‘প্লাস’ পয়েন্ট ভুরি ভুরি; আপাতত বাইরের লোকদের বিবেচনায় অন্তত আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশ দারুণ সফল। এতোটাই সফল যে, প্রখ্যাত ক্রিকেট সাংবাদিক পিটার রোবাক বিস্মিত হয়ে বলে ফেলেনÑ‘বাংলাদেশের তো একাই বিশ্বকাপ আয়োজন স্বত্ত্ব পাওয়া উচিত। এতো অসাধারণ আয়োজক দেশ দুনিয়ায় খুব কমই আছে।’ 
হ্যা, আমরা খানিকটা ‘হীরক রাজা’র কৌশল ধারণ করেছিলাম। গরীবি, অব্যস্থাপনা লুকিয়ে ফেলেছিলাম আমরা। অবশ্য আধুনিক বিশ্ব এসব দেখতেও চায় না। এসব গরীবি দেখতে চায় দাতা সংস্থাগুলো। এসব দেখিয়ে লাভ ‘নোবেল-ওয়ালা’দের! বিশ্বকাপ তো আর দাতা সংস্থাদের মুগ্ধ করার জন্য নয়। তাই গরীবদের রাতারাতি উধাও করে দিয়ে, রাস্তাঘাট ফাকা করে, আলোয় ঝলমলে একটা ঢাকা বানিয়ে ফেলেছিলাম আমরা। তাতে দারুণ মুগ্ধ বিদেশী খেলোয়াড়, কর্মকর্তা, সাংবাদিকরা।
অবশ্য এসব বলে মানুষের প্রবল পরিশ্রমকে খাটো করার কোনো মানেও হয় না। সত্যি কথা বলতে হবে, ঢাকা-চট্টগ্রামে বিশ্বকাপ সফল করতে কয়েক হাজার মানুষ ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রানান্ত পরিশ্রম করেছে। আয়োজ কমিটির সঙ্গে জড়িতদের নাম-টামের মোহ ছিল। কিন্তু কয়েক শ স্বেচ্ছাসেবকের এসব কোনো প্রাপ্তি ছিল না। তারপরও উদায়স্ত অসামান্য পরিশ্রম করে বিশ্বকাপটাকে সুন্দর করে তুলেছেন এরা। 
এদের সঙ্গে বিশেষ একটা ধন্যবাদ পাবেন পুলিশ, আনসারসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কোনো ধন্যবাদের আশা না করেই এই বাহিনীগুলোর সদস্যরা আক্ষরিক অর্থে সকাল-সন্ধা পরিশ্রম করেছেন। এমনকি আয়োজকদের দেওয়া খাবার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তিও ছিলেন। 
অথচ এই জায়গাটায় বাংলাদেশের খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। তৃতীয় বিশ্বের মুসলিম প্রধান দেশ বলে; বাংলাদেশকে একটা জঙ্গল বলে প্রমানের চেষ্টা ইউরোপ-আমেরিকা এখনও কম করে না। এখানে ক্রিকেটাররা যে নিরাপদে থাকবেন, এটা তাদের জন্য বিশ্বাস করাই কষ্ট। কিন্তু আমাদের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সবসময়ের মতো এসব ধারণাকে ফালতু বলেই প্রমান করে দিয়েছে। 
ট্রাফিক সিস্টেম টিকিয়ে রাখতেও সেই ‘হীরক রাজা’র বাতলানো পথ নেওয়া হয়েছিল। সাধারণের মারাত্মক দূর্ভোগ তৈরি করে পরিস্কার করা হয়েছিল খেলোয়াড়দের পথ। যে ভাবেই হোক ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে না পড়াটাও একটা কৃতিত্বের ব্যাপার ছিল অবশ্যই। কৃতিত্বের ব্যাপার ছিল সৌন্দর্যবর্ধনের বিষয়টি। সৌন্দর্যের প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি মার্ক পাবে মিরপুর শের-ই বাংলা স্টেডিয়াম নিজে। 
মিরপুর স্টেডিয়ামের প্লাজা, মিডিয়া সেন্টার, প্রেসবক্স, অ্যাকাডেমি, সর্বোপরি ঝা চকচকে মাঠ দেখে এক্কেবারে চোখ কপালে উঠে গেছে বিদেশী সাংবাদিক ও খেলোয়াড়দের। দিল্লী ভিত্তিক দৈনিক দ্য ট্রিবিউন-এর ক্রীড়া সাংবাদিক জয়দীপ ঘোষ বলছিলেন, ‘প্রায় তিরিশ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে দুনিয়ার সব টেস্ট ভেন্যুতে ক্রিকেট কাভার করেছি। কোথাও এটা ভালো, কোথাও ওটা ভালো। তবে সবকিছু মিলিয়ে এমন দুর্দান্ত প্যাকেজ কোথাও নেই। আর এমন সার্ভিস সম্ভবত দুনিয়ার কোনো ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাওয়া যাবে না।’
আয়োজনের প্রশংসা যথেষ্ট হয়েছে না? এবার কিঞ্চিত গো-চোনা সম্পর্কে বলা যাক। বাংলাদেশের পুরো বিশ্বকাপ আয়োজনে কালির ছিটে দুটোÑওয়েস্ট ইন্ডিজের বাসে ঢিল পড়া ও উইকেটের মান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাসে ঢিল ছোড়া নিয়ে নিন্দা-মন্দ কম হয়নি। তবে এ ব্যাপারে আবারও বলি, দায় যতো না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর, তার চেয়েও বেশি আয়োজক কমিটির কর্তাদের। 
এই কর্তারা কিছু সস্তা সেন্টিমেন্ট চেয়েছিলেন, সেটার ফলও পেয়েছেন। দ্বিতীয় ব্যাপারটি, মানে উইকেট প্রসঙ্গে আমাদের কর্মকর্তাদের রীতিমতো জবাবদিহি করা দরকার। একমাত্র ভারতের সঙ্গে ম্যাচটা বাদ দিয়ে একটি ম্যাচেও স্পোর্টিং উইকেট পাওয়া যায়নি। এটা কোনোভাবেই বৈশ্বিক একটা টুর্নামেন্টের জন্য ভালো কোনো ব্যাপার হতে পারে না। 
প্রতিটা ম্যাচে লো বাউন্স আর স্লো বল! মিরপুরে যেমন তেমন, চট্টগ্রামে দুটো উইকেট তো একেবারে যাচ্ছেতাই ছিল। হ্যা, একটা যুক্তি আছে, এমন উইকেট বানানো হয়েছিল বাংলাদেশের জন্যই। ধন্যবাদ। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনাল দুটোতে তো বাংলাদেশ ছিল না। সেখানে একটু স্পোর্টিং উইকেট বানানো যেতো না? যেখানে ব্যাটে, বলে খানিকটা লড়াই যেন অন্তত হতে পারতো। 
সে যাকগে। এখন তো আর কথা বললে উইকেটের মান বাড়বে না। তবে উইকেট ভালো না করলে ওই ৫৮ ও ৭৮ কান্ড কিন্তু ঘটতেই থাকবে। এখন দেশে হচ্ছে। এরপর বাইরে গিয়ে পেস-বাউন্স খেলতে গিয়ে ৪৮-৬৮ কান্ডও হয়ে যেতে পারে। 
আচ্ছা ক্রিকেটের কথা যখন চলেই এলো। আমাদের দলের ক্রিকেট পারফরম্যান্সটাও একটু ফিরে দেখা দরকার। সোজা হিসেব বলে আমাদের খেলা একেবারে খারাপ হয়নি। ছয় ম্যাচ খেলেছিÑ৩ জয়, ৩ পরাজয়। পঞ্চাশ ভাগ সাফল্য। খারাপ কি? এই সেদিন জেমি সিডন্সও একই যুক্তি দিলেন, ‘ছয় ম্যাচের মাত্র দুটোতে আমরা খারাপ ব্যাটিং করেছি। বাকি গুলোতে ব্যাটিং ভালোই হয়েছে। ছয় ম্যাচের ৩ ম্যাচ জিতেছি। রেজাল্ট সবমিলিয়ে খারাপ বলা যাবে না।’ বিশেষ করে ইমরুল কায়েসের ব্যাটিং, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শফিউল ইসলামের বোলিং এই টুর্নামেন্টে আমাদের বিশেষ প্রাপ্তি। 
কিন্তু আসলেই কি টুর্নামেন্টেটা বিন্দুমাত্র প্রাপ্তির ছিল? বাংলাদেশের জন্য অন্তত নয়। প্রাপ্তি ব্যাপারটা ঠিক কাগজে কলমে হিসেব কষে বোঝা যায় না। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে দুবার এক শ রানের নিচে অলআউট হওয়া দল কোনো এক ম্যাচে চার শ রান করেও তৃপ্তিতে ভুগতে পারে না। ওই চার শ রানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ন হয়ে দাড়ায় তখন ৫৮ ও ৭৮ রানের ঘটনা দুটো। 
আর জেমি সিডন্স যে চার ম্যাচে ভালো ব্যাটিংয়ের কথা বলছেন, সেখানে কি এমন ভালো ব্যাটিং হল? ভারতের গা এলিয়ে দেওয়া ম্যাচে পৌনে তিন শ রান; এ ছাড়া কোন ম্যাচে বাংলাদেশ স্বচ্ছন্দে ব্যাটিং করেছে? দেখুন, ক্রিকেট শক্তি, সে ছোট হোক আর বড়, তার একটা সাধারণ বৈশিষ্ট থাকেÑনিজের চেয়ে ছোট দলের বিপক্ষে অন্তত গর্জে ওঠা। 
এই সেদিনও আমরা দেখলাম, প্রতিপক্ষ হিসেবে কেনিয়াকে পেয়ে নিঃস্বপ্রায় জিম্বাবুয়েও তিন শতাধিক রানের ইনিংস দাড় করিয়ে ফেললো। আমরা কেন নেদারল্যান্ড বা আয়ারল্যান্ডকে পেলেও এমন কিছু করতে পারি না। প্রশ্নটা আমাদের প্রয়োগের ক্ষমতা ও ধারাবাহিকতার। 
এখন একটা কথা মেনে নিতেই হচ্ছেÑ৫৮ ও ৭৮ কোনো দূর্ঘটনা নয়, দীর্ঘ বছর খানেক ধরে চলে আসা ব্যাটিং ব্যর্থতার ধারাবাহিক পরিণতি। সাকিব আল হাসান কথায় কথায়, গত বছর খানেকে বাংলাদেশ, দলের ফলাফলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করেন। আমরা সেই বছর খানেকেই একটু ফিরে তাকাই। 
গত বছর, মানে ২০১০ সালের শুরুতে বাংলাদেশের ব্যাটিংটা আসলেই দারুণ হয়েছিল। ঢাকায় ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে পর পর তিন ম্যাচে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৯৬/৬, ২৪৯/৯ ও ২৪৭/৬। 
এরপরই শুরু বাংলাদেশের ব্যাটিং খরা। পরের সময়টাতে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটোয়াশ করেছে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ জিতেছে, ইংল্যান্ডকে ইংল্যান্ডে গিয়ে হারিয়েছে; কিন্তু রান করতে ভুলে গেছে তারা। 
সেই ত্রিদেশীয় সিরিজের পর থেকে এই বিশ্বকাপের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ দল ২৯টি ম্যাচ খেলেছে; যেখানে ইনিংস প্রতি রান২০০-এরও নিচে নেমে এসেছে। এই সময়ে বাংলাদেশ মাত্র তিন বার ২৫০ বা তার বেশি রানের ইনিংস খেলতে পেরেছে। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটা বাদ দিলে সর্বশেষ তারা ২৫০ রানের মুখ দেখেছে ১৯ ম্যাচ আগে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।
এর সবকিছুই বলে দেয় ‘বিখ্যাত ব্যাটিং কোচ’ জেমি সিডন্সের উপস্থিতি স্বত্ত্বেও বাংলাদেশের ব্যাটিং অত্যন্ত ঠুনকো একটা চেহারা ধারণ করেছে। যার চরম অবনমিত চেহারা আমরা দেখলাম বিশ্বকাপে। ফলে এই বিষয়টিকে দূর্ঘটনা বা ঠিক আছে বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে লাভ নেই। 
আজ বিশ্বকাপে আমাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে কথা হচ্ছিল। সেখানে এসব কথা না আসাই ভালো ছিল। কিন্তু বিশ্বকাপের এটাই প্রাপ্তি যে, আমরা এখান থেকে চাইলে বাস্তববাদী হওয়ার উপকরণ খুজে নিতে পারি। চাইলে এখান থেকে নতুন করে শুরু করার পরিকল্পনা করতে পারি। 
থাক, আর আত্মসমালোচনা নয়। বরং আসুন, আরেকবার নিজেদের গর্বের কথা মনে করে নেই। বলুন তো তাহলে, এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল কারা? আয়োজক, প্রশাসক, ক্রিকেটার নাকি কর্মকর্তারা? কেউ না! এবার বাংলাদেশ বিশ্বকাপের সবচেয়ে সফল হলেন সমর্থকরা। এই সমর্থকদের দেখে, তাদের উন্মাদনা দেখে যে মুগ্ধতা দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছে, সে কোটি টাকায় কেনার নয়। 
এই সমর্থকদের ব্যবহার করে কেউ নিজের পক্ষে হাতে তালি নিতে পারেন, কেউ বাহবা কুড়াতে পারেন। তবে এই সমর্থকদের শ্রেষ্ঠতম ব্যবহারের কথাটা বলে গেলেন সেই পিটার রোবাক, ‘যে কোনো খেলায় সমর্থকরাও একটা রিসোর্স। আর রিসোর্সের বিবেচনায় বাংলাদেশ সম্ভবত এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় সমৃদ্ধ দেশ, ভারতের পর। তাহলে বাংলাদেশ কেন নিজেদের পৃথিবীর দুই নম্বর ক্রিকেট শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে না?’
প্রশ্নটার উত্তর এবার খোজা বড় জরুরী হয়ে পড়েছে।

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites