ধরা যাক, তার নাম কাদের। বাসায় ফিরে কাদের তাঁর বন্ধু রাম বা রহিমকে বললেন, ‘আজ স্টেডিয়াম থেকে বেরোতেই বিরাট এক কাণ্ড! শখানেক লোক কোত্থেকে দৌড়ে এসে ঘিরে ধরল আমাকে···।’
‘সে কী!’‘হ্যাঁ। আমিও তো অবাক। বলে কিনা অটোগ্রাফ চাই। কেউ আবার ক্যামেরা বের করে ছবি তুলছে। সে কী ঝামেলা গেল!’
একেবারে বাতাসের মানুষ (মাটির মানুষের চেয়ে নিরীহ আর কি) কাদের নিতান্ত বিনে পয়সায় টিকিট পেয়ে খেলা দেখে এসে এমন গল্প বলছে! আপনি-আমি হলে যা করতাম, রাম বা রহিমও তা-ই করল। চোখ আকাশে বা তারও ওপরে তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘স্টেডিয়ামের বাইরে একসঙ্গে ১০০ লোক তাহলে অন্ধ হয়ে গেল বলতে চাস?’
‘আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? ১০০ তো কম বলেছি। আমার ধারণা, অন্তত শ তিনেক লোকের ভিড় ছিল। বিশ্বাস না হয় মাশরাফিকে জিজ্ঞেস করে দেখিস। আমার ঠিক সামনে মাশরাফি দাঁড়ানো ছিল।’
ভিড় জমা নিয়ে কথা। সে মাশরাফিকে দেখে ভিড় জমুক আর কাদের সাহেবকে দেখে; তফাৎটা কী?
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাবিবুল বাশার ও রকম ভিড় দেখলেন। আইসিএলের ম্যাচ খেলতে ঢাকা ওয়ারিয়র্সের হাবিবুলেরা তখন আহমেদাবাদে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে হাবিবুল দেখলেন সেই ভিড়। একজন ক্রিকেটারকে চারপাশ থেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে জনা পঞ্চাশেক লোক। ভারতের মতো দেশে ক্রিকেটারকে ঘিরে ভিড় হতেই পারে। কিন্তু হাবিবুল চমকালেন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো মোহাম্মদ রফিককে দেখে। হাবিবুলের চমকটা কাটতে না কাটতেই আরেক দফা চমক।
রফিক কী একটা নির্দেশ দিলেন। ভিড়টা সঙ্গে সঙ্গে নড়ে উঠে সবাই মিলে এক লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাবিবুলের ঘোর আর কাটে না।
সুশৃঙ্খল সৈনিকের মতো লাইন বেঁধে দাঁড়ানো লোকগুলোর হাতে এবার রফিক একটা একটা করে কী যেন ধরিয়ে দিচ্ছেন। প্রত্যেকে রফিকের হাত থেকে দুই হাত পেতে রহস্যময় সেই জিনিসটা নিয়ে আবার মাথা নিচু করে কী যেন বলছে। আর রফিকও মুখ গম্ভীর করে কী যেন বলে উত্তর দিচ্ছেন। এই ভারতে এসে রফিক তাহলে নিশ্চয়ই সাধুটাধু হয়ে গেছেন! ওদের বর দিচ্ছেন এখন নিশ্চয়ই।
হন্তদন্ত হয়ে হাবিবুল নিচে নামতেই সিঁড়ির গোড়ায় দেখা রফিকের সঙ্গে। সাধু রফিক হাসতে হাসতে ফিরছেন, ‘ওদের টিকিট দিলাম।’
‘টিকিট!’
‘হ্যাঁ, ফ্রি যে টিকিটগুলো পেয়েছিলাম আমরা, সেগুলো এই লোকগুলোর মধ্যে বিলিয়ে দিলাম। তবে বিনা শর্তে দিইনি···।’
‘কী শর্ত দিয়েছিস?’
‘বলেছি, আমাদের টিকিট নিয়ে খেলা দেখবা, মাঠে এসে আমাদের সাপোর্ট করতে হবে!’
ওই লোকগুলো সমর্থন করেছিল কি না, তা আর বোঝার উপায় রইল না। মুম্বাইতে বোমা আক্রমণে খেলাটেলা ফেলে তড়িঘড়ি করে ফিরে আসতে হয়েছে দেশে। জীবন বাঁচানো বড় পুণ্য।
জীবন বাঁচানোও কি সহজ কাজ। আইসিএলের আমাদের একজন ক্রিকেটার মুম্বাই ঘটনার সময় জীবন বাঁচাতে কী না করেছেন!
ভদ্রলোকের নাম নাহয় না-ই বলি। শুধু এটুকু জানুন, তিনি একজন বড় বোলার, বাঁহাতি স্পিনার; নাম ধরুন শফিক। বেশ সাহসী মানুষ বলে পরিচিত বলে আমাদের ভীতু হাবিবুল (তিনি জোর গলায় দাবি করেন, তিনি ভীতু মানুষ) ঠিক করলেন, শফিকের রুমে গিয়ে রাত কাটাবেন। বলা যায় না, মুম্বাই থেকে আক্রমণ তো আহমেদাবাদেও পৌঁছাতে পারে!
আগে থেকে বলে রাখা কথামতো রাতের বেলায় শফিকের রুমে গিয়ে নক করলেন হাবিবুল। নক করতেই হুড়মুড় করে কী একটা শব্দ হলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না। আবার নক করলেন, ডাকাডাকি করলেন, দরজা ভেঙে ফেলার উপক্রম করলেন হাবিবুল। কারও সাড়া নেই।
সতীর্থদের ডেকে আনা হলো। সবাই মিলে একটানা ডাকাডাকি করতে করতে অবশেষে তিনি দরজা খুললেন। মাথায়, হাতে ময়লা লেগে রয়েছে, বিধ্বস্ত চেহারা। মুখটা করুণ করে বললেন, ‘আমি তো বাইরে শব্দ পেয়ে ভাবলাম, আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। তাই খাটের তলে···।’
ও রকম আক্রমণের ভয়ে ভীত আইসিএলের একজন ক্রিকেটার (এবার আর কিছুতেই নাম বলা যাবে না) বিমানে উঠতে চাইছেন না-যদি বিমানে বোমা আক্রমণ হয়? (তার সঙ্গে মিলিয়ে একটি কৌতুক জুড়ে দিয়ে চলুন লেখাটা শেষকরি।) তাকে সবাই মিলে বোঝাল, বিমানে বোমা আক্রমণের আশঙ্কা খুবই কম। ‘কত কম?’-সেই ক্রিকেটার প্রশ্ন করলেন।
‘শতকরা এক ভাগ।’
কী যেন ভেবে আবার ওই ক্রিকেটার জানতে চাইলেন, ‘এই বিমানে আলাদা দুই পক্ষ বোমা নিয়ে ওঠার আশঙ্কা কতটুকু?’
একজন বিমান ‘বিশেষজ্ঞ’ ভেবে জবাব দিলেন, ‘কোটি ভাগের এক ভাগ।’
‘ঠিক আছে। কাল আমি বোমা নিয়ে তবে বিমানে উঠব। ওই কোটি ভাগের এক ভাগ সম্ভাবনাটুকুও আমি অন্যের হাতে ছেড়ে দিতে চাই না।’
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০২, ২০০৯
Facebook comments for blogger brought to you by AllBlogTools.com