বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১১

কাকাবাবুর জন্য কান্না

চোখ দুটো ঈষৎ রক্তবর্ণ। হিমেল হাওয়ায় মৃদু মৃদু উড়ছে তাঁর শুভ্র দাড়ি। কুয়াশার পাহাড় ঠেলে এসে সামনে দাড়ালেন মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। চোখ মুখ স্পষ্ট বলে দি”েছ প্রিয়জন বিয়োগের বেদনায় কাতর তিনি। 
প্রশ্নভরা চোখ নিয়ে সামনে যেতে নিজেই বলে দিলেন সেই প্রিয়জনের কথা, ‘আমার কাকাবাবু আর নেই। শেষবারের মত একবার নিজের বাড়ি আসা হল না কাকাবাবুর।’
‘কাকাবাবু’ মানে কমরেড মোজাফফর আহমেদ বা রাজা রায়চৌধুরি নন। নারায়নগঞ্জ জেলার বারদী গ্রামের এই ‘কাকাবাবু’ পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। গ্রামের লোকজনের ভাষায়, ‘আমাগো গ্রামের পোলা’!
যুক্তিবিজ্ঞানের হিসেবে জ্যোতি বসু ‘বারদীর পোলা’ হওয়ার কোনো কারণই নেই। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পশ্চিমবঙ্গে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা এই মানুষটির জš§ কলকাতাতে। সেখানেই বেড়ে ওঠা। তারপরও জ্যোতি বসু নাকি বারদীর মানুষ!
এই স্বীকৃতিটা অবশ্য জ্যোতি বসু নিজেই দিয়েছেন। চিকিৎসক বাবার সঙ্গে থাকতেন কলকাতায়। কিš‘ নিজেদের পুরোনো ভিটেটায় যাতায়াত ছিল তার ছোটবেলা থেকেই। সেই সুবাদে গ্রামের বাড়ি বলতে এই বাড়িটাকেই চিনতেন। কিংবদন্তী হয়ে ওঠার পরও বার দুয়েক এই বাড়িতে এসেছেন। 
১৯৯৭ সালে একবার বারদীতে আসা জ্যোতি বসু নিজের বাড়িতে ফিরে পুরোনো আমগাছটায় হাত রেখে চোখের জল ফেলেছিলেন। সেই গাছটা দেখিয়ে দিয়ে এবার চোখের জল ফেললেন শহীদুল্লাহ সাহেব। 
শহীদুল্লাহ সাহেবরা বংশানুক্রমে বসু পরিবারের প্রজাতুল্য বলা চলে। এখন ‘জ্যোতি বসু বাড়ি’ বলে যে বাড়িটি পরিচিত, সেটি আসলে তার নানার বাড়ি। স্ত্রী-সূত্রে এই বাড়ির অধিকারী হয়েছিলেন জ্যোতি বসুর বাবা ডাক্তার নিশিকান্ত বসু। 
এই বাড়িতেই একসময় চিকিৎসার উপকরণ সাজিয়ে বসেছিলেন ডাক্তার বসু। সেই সময় থেকেই শহীদুল্লার মা-বাবা দু জনই কাজ করতেন বসু পরিবারে। হিন্দু মধ্যবিত্তদের কলকাতামুখী স্রোতে যোগ দিয়ে নিশিকান্ত বাবু যখন কলকাতায় চললেন, সঙ্গে শহীদুল্লার বাবা ফকির মোহম্মদও চললেন। বাবুকে কি একা ছাড়া যায়!
আর এদিকে দেশের বাড়ির দেখভালের দায়িত্বে রইলেন শহীদুল্লার মা হায়াতুন্নেছা। ছেলেকে সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়িয়ে সভ্য সমাজের লোক করতে চেয়েছিলেন নিশিকান্ত বাবু। সঙ্গে সঙ্গে শেকড়ের টানটা যাতে ছেলেরা ভুলে না যায়, সে জন্য বছরে একবার দু বার সকলে মিলে বাড়িতে বেড়াতেও আসতেন। 
সেই দিনগুলো যেন উৎসবের দিন ছিল। ঘোমটার আড়াল থেকে চকচক করে উঠল শহীদুল্লাহ সাহেবের বোন সখিনা বিবির চোখ, ‘কাকারা যখন আইতেন, পাড়ায় মেলা বইসা যাইত। কলকাতা থেইকা আমাগো জন্য কত কি নিয়া আসতেন! এখানে আইসা বাজার থেইকা সবার লাইগা খেলনা কিনতেন।’
শহীদুল্লাহ সাহেব আজ পেছন ফিরে দেখতে পান, সে সময়ে জ্যোতি বসুর আচরণে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কটা প্রকাশ পেত না, ‘‘আমাদের সঙ্গেই খেলতেন। আমার বড় ভাই হাবিবুল্লাহ ওনার বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল। দু জনে মিলে নদীতে যেতেন। কাকাবাবুর বড় ভাই সুরেন কাকাও আসতেন। সবাই মিলে এই গাছ থেকে আম পাড়তাম। আমি গাছে উঠতে গেলে কাকাবাবু বলতেন, ‘পড়ে যাবি। আমি উঠি।’’
ওদিকে সখিনা বিবি বলে চলেছেন, ‘বাবা তো তখন কলকাতায় কাকাবাবুদের ওখানেই চাকরি করতেন। আমি ছোটবেলায় প্রায়ই বাবার কাছে যেতাম। ওই সময় দেখেছি, কাকা কত মজা করতেন। কত পড়াশোনা করতেন।’
এক জায়গায় বসে গল্প বলারও উপায় নেই। শহীদুল্লাহ সাহেব, সখিনা বিবিদের বারবার উঠতে হ”েছ। ঢাকা থেকে, কলকাতা থেকে সাংবাদিকরা আসছেন। একটু যেন অধৈর্য্য হয়ে গেলেন শহীদুল্লাহ সাহেব, ‘মরার পর এখন সবাই কাকাবাবুকে নিয়ে হইচই করছে।’ তাই তো হয়!
কাকাবাবুর সঙ্গে শহীদুল্লাহ সাহেবদের, এই বারদীর সম্পর্কে অবশ্য একটা লম্বা ছেদ পড়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল দুই পরিবারে। অবশেষে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জ্যোতি বসুই উদ্যোগ নিলেন পুরোনো বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক আবার জোড়া দেওয়ার। খুজে বের করলেন এই শহীদুল্লাহ সাহেব, হাবিবুল্লাহ সাহেবদের। 
সেই থেকে আবার যাতায়াত শুর“। প্রতি বছর বারদীর এই বাড়ি থেকে কেউ না কেউ যেতেন কলকাতায়। খালি হাতে যেতেন না। কাকাবাবুর বাড়িতে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করছিলেন শহীদুল্লাহ সাহেব, ‘যাওয়ার সময় লোকনাথ ব্রম্মচারীর আশ্রম থেকে প্রসাদ নিয়ে যেতাম। সঙ্গে কখনো মধু, কখনো বাড়ির আম নিয়ে যেতাম। কাকাবাবুও খুব যতœ করতেন।’
কেমন যতœ করতেন? শহীদুল্লাহ সাহেবের আগেই উত্তর দিলেন ইউসুফ আলী। জ্যোতিবসুর বাল্যকালের সঙ্গী হাবিবুল্লার ছেলে ইউসুফ আলীই শেষদিকে জ্যোতিবসুর সঙ্গে যোগাযোগটা রাখতেন। ফলে তার স্মৃতিটা অনেক টাটকা, ‘আমরা কেউ গেলে ওনার বালিগঞ্জের বাড়িতেই থাকতাম। কখনো টেরই পেতাম না, এতো বড় একজন মানুষের বাড়ি গেছি। আমরা ওনার আÍীয়, বেড়াতে এসেছি; এমন ব্যবহারই করতেন।’
১৯৮৭ ও ১৯৯৭ সালে দু বার এসে তেমন ব্যবহারই করেছেন। সে স্ব্যা শুধু এই পরিবারের লোকজন না, পাড়ার লোকজনের মুখেও মিললো। শুধু মুখে নয়, ¯’ানীয় লোকজন কাজেও প্রমান করে দিতে চান, জ্যোতি বসু তাদের গায়ের ছেলে ছিলেন। সেই প্রমান দিতেই ১ জানুয়ারি এই বাম নেতার অসু¯’তার খবর পেয়েই বিশেষ মিলাদের আয়োজন করা হয়েছিল বারদীতে। 
সকাল বেলায় হাটতে হাটতে এই বাড়ির সামনে আসা ¯’ানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আলাউদ্দিন বললেন, ‘উনি এতো বড় নেতা, বিশ্বের সবাই ওনারে চেনে। কিš‘ আমাদের এখানে এসে এলাকার ছেলের মতই কথাবার্তা বলেছেন। আমাদের বাবা-দাদার খবর জানতে চেয়েছেন। নিজের পুরোনো দিনের কথা বলেছেন।’
আলাউদ্দিন সাহেব নিজেও জ্যোতি বসুর ছোটবেলা সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছেন বাবা-দাদার মুখে। সেসব গল্প মিলিয়ে তিনি মুখ কালো করে বলেন, ‘আরেকবার ছোটবেলার বাড়িতে নাকি আসতে চাইছিলেন। কিš‘ তা আর হল না।’
এই আফসোসটাই যেন এলাকার সবাইকে পোড়া”েছ। শেষবার শহীদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে কলকাতায় যখন দেখা, তখন নাকি জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘আরেকবার বাড়ি যেতে চাই। আমগাছটার কথা, কুয়াটার কথা মনে পড়ে।’
সেই কুয়াটার দিকে চেয়ে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারেন না শহীদুল্লাহ সাহেব। চোখের জল মুছে বলেন, ‘কাকাবাবুর তো আর আসা হল না। এখন আমার খুব ই”েছ, একবার তার দেহটা যদি দেখতে পারতাম!’
আরেকটা ই”েছ আছে এলাকাবাসীর। বাজার থেকে শুর“ করে জ্যোতি বসুর বাড়ি পর্যন্ত, সবার মুখে এক কথা, ‘এখানে একটা স্মৃতিসংগ্রহশালা করা দরকার।’ আলাউদ্দিন সাহেব বলছিলেন, ‘সরকার তো অনেকবার বলছে, এখানে একটা লাইব্রেরী বা কিছু করবে। কিছু একটা করে জ্যোতি বসুর স্মৃতি ধরে রাখাটা খুব জরুরী।’
কিš‘ সেটা করতে গেলে শহীদুল্লাহদের যদি এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়। বৃদ্ধ শহীদুল্লাহ মাথা নেড়ে বললেন, ‘কাকাবাবুর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য আমার বাড়ি ছাড়তে কোনো আপত্তি নেই। নিজেগো কথা ভাইবা তো কাকাবাবুরে হারায়ে যেতে দিতে পারি না।’
এই বোধহয় সত্যিকারের আত্মীয়, রক্তের নয়!

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites