বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১১

ক্রিকেট খেলা কেন দেখব!

স্যার ডন ব্রাডম্যান যে ক্রিকেট খেলতেন, নেভিল কার্ডাস যে ক্রিকেট নিয়ে লিখেছেন; সেই ক্রিকেট আর আজকের দিনের ক্রিকেট এক খেলা নয়। খেলাটির সঙ্গে যে রোমান্টিসিজম জড়িয়ে ছিল তা সম্ভবত চিরতরে দূরে চলে গেছে। বিশ্বজুড়ে ব্যাট-বলের মধুর সেই সঙ্গীতের জায়গাটা দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোনের কর্কশ আওয়াজ। লোভ আর হুমকি খেলাটিতে সম্পৃক্ত করেছে বিপুল অর্থ এবং নিয়ন্ত্রন চলে গেছে অন্ধকার জগতের হাতে।

ম্যাচ পাতানো বিষয়ক সিবিআই তদন্ত কমিটির (২০০০) রিপোর্টের উপসংহার




গত বছর চারেক ধরেই আমার মাথার ভেতর এই প্রশ্নটা ঘুরছিল-ক্রিকেট খেলা আর দেখব কেন? প্রশ্নটা আরেকটু উস্কে দিলেন হাসান তিলকরত্নে। শ্রীলঙ্কান কিছু খেলোয়াড়ের বাজিকরদের সঙ্গে যোসাজস নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই গুঞ্জন চলছিল। তিলকরত্নে জানালেন, ঘটনা সত্যি। আবার মনে হল, কেন নিজেকে এই প্রতারনার শিকার হতে দেব?
কেমন প্রতারণা? 
ধরুন কোনো একজন বোলারের বোলিং দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম; দু দিন পর পত্রিকায় দেখলাম, ওই বোলিংটা করার পথে সে তিনটি ‘নো বল’ করেছে অর্থের বিনিময়ে। কোনো একটা টানটান উত্তেজনার ম্যাচ দেখে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। শেষ ওভারে ১২ রান দরকার, শেষ বলে চার; শেষ পর্যন্ত জয়-পরাজয় নির্ধারিত হল ১ রানে। পরে জানা গেল; ম্যাচটা পাতানো ছিল।
এই পাতানোর খেলায় ক্রিকেটের কতোটা ক্ষতি করছে, সে বিবেচনায় না হয় নাই গেলাম। কিন্তু নিজেকে হাস্যকর এক পাতানো নাটকের নির্বোধ দর্শক হিসেবে ভাবতে আর ভালো লাগে না। আমি যা নিয়ে উত্তেজিত হই, যা দেখে রোমাঞ্চিত হই; পরে সে সবকিছুকে সাজানো নাটক বলে জানতে আর ভালো লাগে না। 
অথচ আমরা এই চক্রের মধ্যে পড়ে গেছি। আমরা এই সময়ে ক্রিকেট দর্শকরা নিতান্তই হাস্যকর ও নির্বোধ চরিত্রে পরিনত হয়েছি। তারা সবকিছু আগে থেকে ঠিক করে রাখবেন, আর আমরা সেই ঠিক করা খেলা দেখে মজা পাওয়ার চেষ্টা করব। শেষ পর্যন্ত ভূক্তভোগী আমরা এই দর্শকরা হলেও এর দায় নিশ্চয়ই আমাদের নয়। দায়টা অবশ্যই আইসিসি কর্তাদের, আরও ভালো করে বললে বলা যায়, দায়টা ভারত ভিত্তিক অসাধু কিছু রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর; যারা এখন ক্রিকেটের দ-মুন্ডের কর্তা হয়ে দাড়িয়েছেন। 
ক্রিকেট এখন যে অন্ধকার জগতের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হয়, সেই জগতে ক্রিকেটের প্রবেশ শুরু হয়েছিল পরিস্কার ভাবে জগমোহন ডালমিয়ার হাত ধরে। ক্রিকেটের ‘গ্লোবালাইজেশনের’ নাম করে খেলাটায় আরও টাকা ও আরও লোভ টেনে এনেছিলেন এই ভদ্রলোক। আর এই কাচা টাকার ওপর বাজি ধরে, সেই বাজি নিজেদের মতো নিয়ন্ত্রন করার নেশায় ক্রিকেটে পঙ্গপালের মতো ছুটে এসেছিল অন্ধকার জগতের লোকেরা। 
তার ফলাফল আমরা ২০০০ সালের দিকে এসে দেখলাম। ক্রিকেটের ভদ্রজনোচিত ভাবমূর্তি ধ্বসেপড়ল। হ্যানসি ক্রনিয়ে, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, সেলিম মালিক, ওয়াসিম আকরামের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় ক্রিকেটারের অন্য এক জীবন বেরিয়ে এলো এই সময়ে। 
ডালমিয়া যে চক্র শুরু করেছেন, শরদ পাওয়ার সেই চক্রের আশ্রয়দাতা হয়ে উঠলেন। আর এই দুষ্টু চক্র পালনের শিল্পী হয়ে ক্রিকেটকে ‘থ্রি সি’ তে পরিনত করলেন লোলিত কুমার মোদী-ক্রিকেট, ক্রাইম, সিনেমা।
খেলোয়াড়রা কেন বাজিকরদের সঙ্গে হাত মেলান? এটা বুঝতে বাজিকরদের স্বার্থটা বুঝতে হবে। ক্রিকেটে বাজি উপমহাদেশে নিষিদ্ধ হলেও ইউরোপে আইনি ব্যাপার। উপমহাদেশে, বিশেষ করে ভারতে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল টপকে দিব্যি চলে বাজির খেলা। তাতে খেলায় কোনো প্রভাব পড়ার কথা নয়। 
খেলার আগে খেলা সম্পর্কে অনুমান করে জুয়ার মতো টাকা লগ্নী করে কেউ লাভ করবে, কেউ লোকসান দেবে; এই তো? কিন্তু এখানেই বাজিকররা তাদের খেলটা দেখাতে শুরু করলেন। তারা ভাবলেন, খেলাটাকে যদি নিয়ন্ত্রন করা যায় তাহলে লাভ পুরোটাই নিজেদের ঘরে আসে। 
যে দলের পক্ষে বাজি বেশি পড়েছে, সেই দল যদি মাঠে হেরে যায়; তাহলে বাজিকররা ফেপে ফুলে ওঠে। সেটাই করা হল খেলোয়াড়দের হাত করে। ম্যাচে ফেবারিট দলকে হারার জন্য পয়সা দেওয়া শুরু হল। এটা অবশ্য পুরো গপ্প; সেই ক্রনিয়ের জামানার গপ্প। এখন দিন বদলেছে। 
এখন ম্যাচ নিয়ে সরাসরি বাজির চেয়ে বেশি লাভ স্পট ফিক্সিংয়ে। এখানে একটি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বাজি ধরা হয়। যেমন প্রশ্ন থাকে-দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম বলে কি হবে। চারটি উত্তর হয়তো থাকল-১. চার রান, ২. কোনো রান নয়, ৩, আউট, ৪. পাচ রান (ওয়াইড চার)। 
মানে একটি দৃশ্যত অসম্ভব অপশন থাকবে। এই অপশনে বাজি ধরার মতো ‘পাগল’ তো খুজে পাওয়া কঠিন হবে। এখন বাজিকররা সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়দের সঙ্গে চুক্তি করে দৃশ্যত অসম্ভব ওই কাজটিই করাবেন। ফলে বাকি তিন অপশনে গন হারে যে বাজি ধরা হয়েছিল, সবার ভরাডুবি; সবার টাকা যাবে বাজিকরদের পকেটে। 
এই ধরণের অভিযোগেই অভিযুক্ত হয়ে নিষিদ্ধ আপাতত পাচ পাকিস্তানী ক্রিকেটার। পাকিস্তানী চার জন্য তো নিষিদ্ধ। তাহলে বলতে পারেন, ক্রিকেটের ওপর ভক্তি কেন উঠে গেছে? বাকিরা তো ঠিক আছে। 
এখানেই তো ভেজালটা। ময়লা সব মাছে খাচ্ছে, দোষ শুধু বেলে মাছের। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা নিজেদের অশিক্ষা; যে কোনো কারণেই হোক, কোনো একটা অভিযোগ উঠলেই পাকিস্তানীদের শাস্তি পেয়ে যেতে আর সময় লাগে না। কিন্তু অভিযোগ তো আরও উঠছে। 
ভারতের পিয়ুস চাওলার বিপক্ষে পরিস্কার গড়াপেটার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠল; আইসিসি তদন্তাটও করল না। সাঙ্গাকারার বিপক্ষে বিশ্বকাপের আগেই অভিযোগ উঠল এক রেস্টুরেন্টে বাজিকরদের সঙ্গে মিটিং করার; ক্রিকেটের এই বিবেককে নিয়ে কোনো তদন্ত হল না। ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে একের পর এক অভিযোগ; বলার মতো কোনো শাস্তি বা ফাইন্ডিংস নেই আইসিসি বা ইসিবির। 
সর্বশেষ বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে গুঞ্জন-শ্রীলঙ্কা কেন বিনা কারণে পরীক্ষিত পারফরামদের রেখে মাঠে নামল? অনেক প্রশ্ন উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। কে উত্তর দেবে? যেই রাম, সেই রাবন। যেই ভারতীয় কর্মকর্তা, সেই আইসিসি। কে কাকে নিয়ে তদন্ত করবে!
তাহলে কি ধরে নেব, সিবিআইয়ের ওই রিপোর্টই শেষ কথা? ক্রিকেট তাহলে পুরোটাই অন্ধকার জগতের নিয়ন্ত্রনে চলে গেছে?
এক বড় ভাই, একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের ক্রীড়া সম্পাদক আমার হতাশা শুনে বললেন, ‘কি সব বলো! আইসিসির সদর দপ্তর যেদিন লন্ডন থেকে দুবাই চলে এলো, সেদিনই তো খেলাটা অন্ধকার জগতে আনুষ্ঠানিক ভাবে চলে গেছে। দুবাইতে অফিস করে কারা?’
কারা?
‘ভারত-পাকিস্তানের মাফিয়ারা। যাদের ওখানে অন্তত পুলিশ ধরতে পারে না। এ যেন নো ম্যানস ল্যান্ড।’
তাহলে আর ক্রিকেট দেখব না!
‘অবশ্যই দেখব। বলিউডের সিনেমা দেখি, হলিউডের সিনেমা দেখি; সে তো অভিনয় জেনেই দেখি। ক্রিকেটও এখন থেকে অভিনয় জেনেই দেখব।’

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites