বুধবার, ২২ জুন, ২০১১

মনোয়ারা বেগমের দুশ্চিন্তা

দুশ্চিন্তা যে কেউই করতে পারে। এতে এখনো অর্থমন্ত্রী ট্যাক্স বসাননি। ফলে এহেন একান্ত ব্যক্তিগত কর্ম করার অপরাধে মনোয়ারা বেগমকে নিয়ে টানা হেচড়া করার কোন মানেই হয়না। তারপরও হচ্ছে। হচ্ছে তার কারন, মনোয়ারা বেগমের দুশ্চিন্তার বিষয় এবং ভঙ্গী।
তার দুশ্চিন্তার বিষয় এই নয় যে, সামনের বার প্রধানমন্ত্রী কে হবেনÑ খালেদা নাকি হাসিনা? বরং মনোয়ারা বেগমের দুশ্চিন্তার বিষয় নিতান্তই তার পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ধরা যাক বিকেল বেলায় আবার চাগাল দিয়ে ওঠা বাতের ব্যাথাটাকে সঙ্গী করে মোমেনার মা চেয়ারাম্যান বাড়ীর দাওয়ায় মাত্র এসে পা দিয়েছে। উদ্দেশ্য, আরো কয়েকটা পানের রসে উঠোনটা এবং দাতগুলোকে আরেক ছোপ খয়েরী করে তোলা। কিন্তু একটা পান মুখে পুরতে না পুরতেই চোখ ডলতে ডলতে দুপুরে গড়াগড়িকে অসমাপ্ত রেখে ঠিক সেই সময়েই উঠে এসেছেন মনোয়ারা বেগম।
‘ও মোয়েনার মা কান্ডডা দেহিছ। তোমাগো ছল সেই সকাল বেলায় হাডে গেছে সুবরি লইয়ে। এহন রাইত হতি আসলো, তার ফেরার কোন নাম দেহ?’Ñ মনোয়ারা বেগমের এরকম আহাজারীতে মোমেনার মা স্বাভাবিক ভাবেই বাস্তব কোন আগ্রহ খুজে পায়না। কারন, সে নিজের চোখেই সকালে নয়, দুপুর বেলাতে হাটে যেতে দেখেছে সালাম চেয়ারম্যানকে। সুপারি চেয়ারম্যান নিয়ে গেছে ঠিকই, তবে নিজে মাথায় করে নেয়নি। গৌরের মাথায় আস্ত একটা ঝাকায় চড়ে বাধাল হাটে গেছে তারা। আর এখন যে মোটেও ‘রাইত’ হয়ে আসছেনা এটুকু মোমেনার মা নিজেই বুঝতে পারে। কিন্তু বুঝলেও সত্যি তো সবসময় বলা যায়না। মাতব্বরের বৌ আর চেয়ারম্যানের মার মুখের ওপর সত্যি কথা বলতে গেলে আর কিছু না হোক পানের বাটাটা হাতছাড়া হতে পারে। তাই আরেকটা পান গালে ঠেসে দিয়ে এবার মনোয়ারা বেগমের দুশ্চিন্তায় কান দেয় সে। ‘এগো আরকি। একখানে যাইয়ে আড্ডায় বইসে গেলিই হইলো। আর আমি মরি চিন্তায়। ওরে দেশ কালের সেই দিন কি আর আছে। কহন জানি কোহানে কি হইয়ে যায়....’
মনোয়ারা বেগমের দুশ্চিন্তা এটুকুতেই থেমে থাকলে কথা ছিলোনা। তার ‘কি যে হবেনে’ টাইপের কথাবার্তায় সবচেয়ে বেশি জর্জরিত থাকে ঘরের নতুন বৌ, মানে সদ্য বিয়ে করে আনা এলাকার চেয়ারম্যানের টুকটুকে বৌ (এই বৌয়ের মারফতই মনোয়ারা বেগমের দুশ্চিন্তা রোগের প্রচার)। সন্ধ্যা হতে না হতেই মনোয়ারা বেগমের যাবতীয় দুশ্চিন্তার কেন্দ্র বিন্দু হয়ে পড়ে একটু রাত করে বাড়ি ফেরা সালাম চেয়ারম্যান। একটু পর পরই নিজের ঘর থেকে পুতের বৌকে ডাক পাড়েন, ‘ও বৌ, সালাম তো এহনো আইলোনা। এতো রাইত হইলো, দেশ কালের যে পরিস্থিতি।’ পুুতের বৌ কাঠের ওপর বসেই কি উত্তর দেয় কি দেয়না। মনোয়ারা বেগম কাথাটাকে আরো টেনে নেন পায়ের ওপর। শীত এখনো পড়েনি। এইতো সেদিন হিন্দু পাড়ায় শেষ হয়ে গেলো বড় পুজো। এমন সময় শীত পড়াটা একেবারেই অনুচিৎ। এটা বুঝেও শীতকে ঠিক দুরে সরিয়ে রাখতে পারেন না তিনি। শীতটা কোথায় না কোথায় ঘুরতে থাকা সালামের জন্য, না কি বয়সের জন্য তাও ঠাওর হয়না। ঠান্ডাটাকে একটু কমিয়ে দিতে প্রতিরাতে আবারো ডাক দেন,
‘ও বৌ ঘুমাইছো নাকি?’
বৌ একটু কড়া সুরেই উত্তর দেয়, ‘না, এই সইন্ধে রাতি আপনি ঘুম দেহেন কোহানে?’
কড়া সুরটা ছোয়না মনোয়ারা বেগমকে। বৌ চেয়ারম্যানের বৌ, সে একটু কড়া সুরে কথা বলতেই পারে। তিনি তো আর চিরকাল এমন চেয়ারম্যানের মা নন। ফলে ওরকম স্বর তাকে নাড়া দিতে পারেনা। আবারো ডেকে বলেন,
‘তোমার ভয় করলি কইয়ো। আমি আইসে ধারে বসপানে।’
কলেজে পড়া বৌ, ভয় শব্দটাই এখন তার কাছে অপমানজনক। মান বাচাতে সে বলে, ‘আপনি তো জ্বালালেন। ভয়ডা কিসির?’
‘ভয়ডা কিসির’ তা এরা বুঝবে কেমন করে। মনোয়ারা বেগম জানেন ভয় কাকে বলে। মনোয়ারা বেগমের ভয়ের কোন রং অবশ্য নেই। তার ভয় কেবলই শব্দের জগতে। নাম না জানা হরেক রকম শব্দ ভয় হয়ে ঢোকে তার কানে। সেই ভয় কেবলই ডাক দিয়ে বলে দুশ্চিন্তা করতে। তাই রাত বাড়তে থাকে আর দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে তার। একটা খস খস শব্দ হয় পশ্চিমের বাগানের দিকে। চিন্তাটা আবারও বেড়ে ওঠে, কি শব্দ হইলো। প্রতিদিনই সন্ধ্যা ঘনাতে না ঘনাতেই মনোয়ারা বেগমের দুনিয়ায় রাতটা বাড়তে থাকে। বিছানা থেকে নেমে হাতড়ে হাতড়ে খুজে বাড় করেন মাটির ঠিলেটা। ইদানিং এই আরেক সমস্যা হয়েছে, সন্ধ্যার পর প্রসাবের বেগ হয় বড় ঘন ঘন। মেয়ে মানুষ কাউকে বলতেও পারেন না। বৌটার কথা যতই কড়া হোক, একটা ঠিলের ব্যাবস্থা করে দিয়ে আরেকটা দুশ্চিন্তার হাত থেকে বাচিয়েছে মনোয়ারা বেগমকে। ঠিলেটা আবার কাঠের তলায় ঠেলে দিয়ে খাঠে উঠতে উঠতে আবার ডাক দেন বৌকে,
‘সালাম কি কিছু কইয়ে গেছে তোমারেÑ কহনে কি ফেরবে।’
বৌ একথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনা বা কথাটা শুনতেই পায়না। অবশ্য উত্তরের জন্য প্রশ্ন করেন না মনোয়ারা বেগমও। আজ না হয় বৌ হয়েছে। যাকে প্রশ্ন করলে উত্তর দিলেও দিতে পারে। এর আগে এতোকাল ধরে তো তিনি প্রশ্নই করে গেছেন, উত্তর দেওয়ার কেউ ছিলোণা। একা একা দুশ্চিন্তা করেছেন, নিজের কথা ভেবেছেন আর প্রশ্ন করেছেন। উত্তর দেওয়ার জন্য এতোবড় বাড়ির ভেতর একটা দুধেল গাই, ক’টা টিকটিকি আর ছাল ওঠা টমি কুকুরটা ছাড়া আর কেউ ছিলোনা। তারপরও দুশ্চিন্তা করে গেছেন তিনি।
আফ্রার আর দশজন বাবুর মা বা নতুন বৌ না হয়ে একান্ত ব্যক্তিগত ব্লাউজটার মতো গোপন মনোয়ারা বেগম নামটাই এই বাড়িতে আসার পর থেকে তার পরিচিতি হয়ে উঠেছে। মাড় দেওয়া শাড়ি শায়া, মনোয়ারা বেগম নাম আর দুশ্চিন্তা এ বাড়ির বৌ হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই জড়িয়ে ধরেছে তাকে। প্রথমে দুশ্চিন্তার বিষয় ছিলো ফেলে আসা বাড়ি। একটু একটু করে সেই যায়গাটা নিয়ে নিলো কাসেম মাতব্বর আর পেটে আসা একটা মাত্র ছেলে হাটতে শেখার পর থেকে সালাম। সালাম হাটতে শেখার আগেই কাসেম মাতব্বর মরে যাওয়ায় একসঙ্গে দুজনকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয়নি মনোয়ারা বেগমকে।
কাসেম মাতব্বর অবশ্য রোগা ভোগা মানুষ ছিলোনা যে ওই বয়সেই ফট করে মরে যাবে। মাতব্বর বাড়ির উত্তরাধিকারি সুপারির ব্যাবসায়ী কাসেম মাতব্বর মরেছিলো গুলি খেয়ে, খান সেনাদের গুলি খেয়ে। কাসেম মাতব্বর জয়বাংলার লোক ছিলো না। বরং মিরাজ মাস্টার আর সফর আলীর সঙ্গেই খাতেরটা তার বেশি ছিলো। গন্ডগোলের তালে কয়েকটা হিন্দুবাড়ি পয়সা না দিয়ে কিনেও ফেলেছিলো মাতব্বর। নিজের ভিটেয় কাঠের ঘরটা বদলে চার ঘরের একতালা একটা দালান তুলে ফেলেছিলো এই সময়ে। সেই প্লাস্টার না করা দালানের ছাদে চকচকে পলেস্টারের একটা চানতারা পতাকাও ওড়াতো সে। সব মিলে আয়োজনে কোন ত্র“টি ছিলোনা। শুধু দাড়ি রাখতে পারতোনা মুখ চুলকায় বলে। বেশ শান্তি শান্তি ভাব নিয়ে মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে কথা বলতো তখন। মনোয়ারা বেগম কিছু পরামর্শ দিতে চাইলে অবশ্য বিরক্ত স্বরে বলতো, ‘তুমি মাইয়া মানুষ কিছু বোঝোনা। খালি প্যাচাল পাড়ো কেনো?’ ধব ধবে সাদা পাঞ্জাবী পরে ঠোটের কোনা থেকে গড়িয়ে পড়া পানের রস সামলাতে সামলাতে রওনা হতো হাটে।
ওই সাদা পাঞ্জাবীই কাল হলো। নামে পাঞ্জাবী সেনা হলেও, পাঞ্জাবী পরিহিত কাসেম মাতব্বরকে দেখে কেনো যেনো শত্র“ শিবিরের লোক বলে ধরে নিয়েছিলো খানসেনারা। সন্ধ্যা বেলায় কেবল বাড়ি ফিরেছে সেদিন কাসেম মাতব্বর। পাঞ্জাবীটা তখনো খোলেনি। এর মধ্যে এলাকায় প্রথমবারের মতো ঢুকে পড়লো একগাদা খান। গ্রামে আর কোন পাকা বাড়ি না থাকায় এই বাড়িটাই প্রথম ল ছিলো। কাসেম মাতব্বর অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো যে সে সাচ্চা পাকিস্তানি। কালেমা চারটেও আউড়ে গিয়েছিলো ঠিক মতো। কিন্তু কিছুতে কিছু হয়নি। রাতের বেলায় ছাদে ওড়ানো চানতারা পতাকা দেখতে পেলো না পাকিস্তানিরা। ধরে নিয়ে গেলো কাসেম মাতব্বরকে। একটা দুশ্চিন্তা কমলো মনোয়ারা বেগমের।
দুশ্চিন্তা বন্ধ হয়নি মনোয়ারা বেগমের। সালাম চেয়ারম্যান বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত এই দুশ্চিন্তা চলতেই থাকবে। আজ অবশ্য দুশ্চিন্তার সঙ্গে আরেকটা উপসর্গ যোগ হয়েছে তার। দাঁতের ব্যাথায় বড় কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। মুখের ডান পাশটা বোধহয় ফুলে উঠেছে। রাতে আর শক্ত কিছু খেতে পারবেন না। বৌকে ডাক দিলেন,
‘ও বৌ জাইগে আছে?’
‘হ, আছি। কেন কি হইছে?’
প্রথমে ভেবেছিলেন দাঁতের ব্যাথাটার কথা বলবেন, তারপর ঠিক করলেন, না থাক। কি হবে বলে, বৌ ছোট মানুষ, খালি খালি ব্যাস্ত হবে। কিছু একটা বলতে হয় তাই বললেন,
‘না, বাইরে কি এটটা শব্দ হইলো। ভাবলাম সালাম আইলো কি না।’
এমন কথা শুনতে অভ্যস্ত বৌ। তাই আর কিছু বলেনা। আর আগে বাড়েন না মনোয়ারা বেগমও। আগে বেড়ে হবেই বা কি। কে বুঝবে তার দুশ্চিন্তার কথা। দেশ কালের সেই আগের দিন আর নেই। আগের দিনও কি এর চেয়ে ভালো ছিলো? তখনও তো সালামকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন তিনি।
সালাম আগে সইন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে আসতো লী ছেলের মতো। লেখা পড়ায় কোনকালেই খুব ভালো না থাকলেও বই খুলে বসতো। কলেজে ওঠার পর থেকে শুরু হলো দেরি করে বাড়ি ফেরা। প্রায়দিন রাইত আটটা-নয়টা বেজে যেতো তার বাড়ি ফিরতে। মাঝে মাঝে কারা সব এসে ওর সঙ্গে রাত কাটাতো। রাতে আলাদা ঘর থেকে ভেসে আসতো সিগারেটের গন্ধ। এই গন্ধটা মনোয়ারা বেগম ভালোই চেনেন। কাসেম মাতব্বরও সিগারেট খেতো। গভীর রাতে সালামের ঘর থেকে ভেসে আসতো তর্ক তর্কির শব্দ। এতো কিসের কথা কাটা কাটি তা বুঝতে পারেন না মনোয়ারা বেগম। যাদের সঙ্গে তোর কথার মিল হয়না তাদের সঙ্গে রাত কাটানোর দরকারটা কি? তবে এই সব ভেবে কোন দিন সালামকে তিনি কোন মন্দ কথা বলেননি মনোয়ারা বেগম। মাঝে মাঝে কেবল বলেছেন,
‘ও সালাম দেশ কালের পরিস্থিতি তো ভালোনা। এটটু সকাল সকাল বাড়ি ফিরিস বাবা।’ সালাম মুখ ঝামটা দিয়ে উত্তর দিতো, ‘দেশ কালের পরিস্থিতির তুমি কি বোঝো।’
সালাম এখনো মুখ ঝামটা দিয়েই উত্তর দেয়। মনোয়ারা বেগম সকাল সকাল বাড়ি ফেলার কথা বলতেই মুখ ঝামটা দেয়। এমনকি বৌটাকেও একই ভাবে কথা শোনায় সদ্য ইলেকশনে জিতে চেয়ারম্যান হওয়া সালাম। ওই এখনো পুতের বৌকে মুখ ঝামটা দিচ্ছে সে। তার মানে সালাম ফিরে এসেছে। তাহলে বোধহয় একটু ঘুমিয়েই পড়েছিলেন তিনি। একটা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলেন মনোয়ারা বেগম। বাইরের ঘরে সালামের গলা শোনা যাচ্ছে। বৌকে বলছে,
‘এতো কথা কও কেনো। কইছি এইহেনে খাতি দেও, তাই দেবা।’
তার মানে আজ আবার লোকজন এসেছে সালামের সঙ্গে। ওরা বোধহয় আজ আবার অনেক রাইত পর্যন্ত আলোচনা করবে। সালামের সঙ্গে আসা লোকগুলো সালামকে বড় ভয় পায়। ওকে ওরা ভাই বলে ডাকে কিন্তু ভয় পায়। কাসেম মাতব্বরকে এমন ভয় পেতো এলাকা থেকে যাবো যাবো করছে এমন হিন্দুরা। সালামকেও লোকেরা তেমনই ভয় পায়। সালামকে মনোয়ারা বেগম এবং নতুন বৌও তেমনই ভয় পায়।
লোকেরা ভয় পায় পায়, তারপরও তার কাছেই আসে। কাথাটাকে এবার পুরো শরীরের ওপর টেনে নিতে নিতে মনোয়ারা বেগম শোনেন কে একজন বলছে,
‘ভাই, নইবগো ঘেরডা লইয়ে তো ভালো ঝামেলা হইলো।’
সালাম প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে জানতে চায়, ‘কেন্ কি হইছে।’
সেই আগের কণ্ঠটা জবাব দেয়, ‘না, আমরা এই গোনে মাছ ধইরে আনলাম না? সের পরে রাকিবির বাপ গেছে থানায়।’
এবার মুখ খারাপ করে ওঠে সালাম, ‘রাকিবির বাপ, মানে আমলীগির ওই চুদির ভাই?’
‘হ, ভাই।’
‘তয় আর কি। পুলিশির ধারে যাইয়ে বাল ফেলাবেনে। ওইয়ে লইয়ে মাথা গরম করিসনে। আমি ওসি সাহেবরে কইয়ে দেবানে।’
এর পর আরো কত কথা হয়। সব শুনতে পান না মনোয়ারা বেগম। কথা একটু করে আস্তে আস্তে হতে থাকে। দাঁতে যন্ত্রনা বাড়তে থাকে মনোয়ারা বেগমের। কমতে থাকে দুশ্চিন্তা আর এই অসময়েও একটু একটু করে বাড়তে থাকে শীত। এরই মাঝে কখন যেনো বৌ এসে ডাকে ভাত খাওয়ার জন্য। টের পান কি পান না তিনি। দাঁতের ব্যাথার কথা বলতে পারেন? নিশ্চই পারেন। না পারলে দুধ দিয়ে যাবে কেনো খাওয়ার জন্য? আরো একটা দিনের শেষ হয় মনোয়ার বেগমের। রাত শুরু হয়। ঠিক ঘুম আসেনা। আসে শব্দ। অনেক ঠক ঠক শব্দ এসে ঘিরে ধরে মনোয়ারা বেগমের অন্ধকারকে। এমন শব্দ সেই গন্ডগোলের সময় থেকে মনোয়ারা বেগমের নিত্য সঙ্গী। ঘুমের ভেতর একটানা কানে এসে বাজে সেই ভয় ধরানি শব্দÑ ঠক, ঠক, ঠক,.......
ঠক, ঠক, ঠক..। আজও শুনতে পাচ্ছেন মনোয়ারা বেগম। এই শব্দে কেঁপে কেঁপে ওঠে তার শরীর। কাপুঁনিতে ভেঙ্গে যায় ঘুম। তারপরও চলতে থাকে শব্দ। সে কি! এ শব্দ তো বাস্তবে আবারো ফিরে এসেছে। পৃথিবীর সেই আদিলগ্ন থেকে আরম্ভ হওয়া সমস্ত দুশ্চিন্তা একলহমায় আবারো এসে ভর করে মনোয়ারা বেগমের মাথায়। কাপঁতে থাকে বুকটা। সালাম তার ঘর থেকে জোর গলায় জানতে চায়,
‘কেডা ওহানে?’
‘দরজা খেলোন, আমরা থানা থেকে...’।
এটুকু শুনেই বাকিটুকু বুঝে ফেলেন মেনোয়ারা বেগম। কে যেনো এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দাঁতের ব্যাথাটা কোথায় যেনো উবে গেছে, চলে গেছে শীত। খাট থেকে ঝটপট নেমে বড় ঘরের দরজার কাছে এগিয়ে যান তিনি। দরজার একপাশে দাড়িয়ে কিসব প্রশ্ন করছে সালাম। আর দরজার বাইরে এরা কারা? থানা থেকে এলে এদের রং এমন ঘোর কালো কেনো? এদের মুখগুলো দেখা যায়না কেনো? কোন দেশের লোক এরা? এরাও কি পাঞ্জাবী পরেনা? সালামকে তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বলে লোকগুলো। সালাম হতভম্বের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়, একবার বৌয়ের দিকে আর শেষ বার মায়ে দিকে। কেনো জানি খুব ভয় পায় ছেলেটা। কতগুলো বছর পরে ডাক দিয়ে ওঠে,
‘মা, মাগো’।
আর কথা বলার সুযোগ দেয়না কোন না কোন জগৎ থেকে আসা কালো রংয়ের মানুষগুলো। হাত ধরে টান দেয় সালামের।
চিৎকার করে বাধা দিতে যায় বৌ। একটু শব্দ করেন না মনোয়ারা বেগম। দরজার ধারে চুপ করে দাড়িয়ে থাকেন তিনি। বৌটা কে জড়িয়ে ধরতে এগিয়ে যান তিনি। বড় ভয় পাচ্ছে বাচ্চা বৌটা। পায়ে টের পান কি যেনো পানি পানি লাগছে। প্রসাবের ঠিলেটা কাত হয়ে পড়েছে। বড় দুর্গন্ধ। দাঁতে ব্যাথাটা এখনও টের পাননা মনোয়ারা বেগম।

ইত্তেফাক সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites