হুমায়ুন আজাদ সাক্ষাত্কার গ্রহণকারীদের নাম দিয়েছিলেন আততায়ী! প্রয়াত কথাসাহিত্যিক নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি করেছিলেন। আজ পর্যন্ত কোনো সাংবাদিক সাক্ষাত্কার নিতে গিয়ে কাউকে মেরে ফেলেছেন বলে শুনেছেন? তবে হ্যাঁ, সাংবাদিকেরা, বিশেষ করে ক্রীড়া সাংবাদিকেরা যে মাঝেমধ্যে একটু আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন, সেটা অস্বীকার করা যায় না। কেমন আক্রমণাত্মক?
খুব বাজে শট খেলে এক ব্যাটসম্যান আউট হয়েছেন। দুর্ভাগ্যবশত তিনিই আবার দলের অধিনায়ক। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে একেবারে জেরবার অবস্থা ওই অধিনায়কের। না পেরে শেষ পর্যন্ত অধিনায়কটি বললেন, ‘আমার জীবনে এর চেয়ে খারাপ শট আমি কখনো খেলিনি।’ এক সাংবাদিক দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনি বলতে চাচ্ছেন যে, এর আগেও আপনি কখনো ক্রিকেট খেলেছেন!’এমন আক্রমণের আশঙ্কা দেখে পালালেও অনেক সময় নিস্তার মেলে না। কাউন্টি ক্রিকেটের ঘটনা। এক ফিল্ডার গোটা চারেক ক্যাচ মিস করার পরই বুঝেছেন, আজ তাঁর রক্ষা নেই। ম্যাচ শেষে সাংবাদিকদের জটলা দেখে আগে থেকেই বললেন, ‘ভাই, আমি কথা বলতে পারব না। আমাকে ট্রেন ধরতে হবে।’ সবাই ছেড়ে দিলেও একটা মন্তব্য উড়ে এল, ‘কোলের কাছের বল ধরতে পারলেন না, স্টেশনের ট্রেন কি ধরতে পারবেন?’
বাংলাদেশে এতটা হয়তো হয় না। তবে ম্যাচ হারলে টুকটাক আক্রমণের শিকার তো হতেই হয়। সেবার ঢাকায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ ম্যাচ হারার পর এমন আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন বাংলাদেশের এক ব্যাটসম্যান। নামটা না হয় না-ই বলি। প্রথম বলেই এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরেছেন ব্যাটসম্যানটি। নানা রকম প্রশ্ন ছুটে আসছে আর মাথা নিচু করে কোনোমতে আত্মরক্ষা করছেন ব্যাটসম্যানটি। হঠাত্ এক সাংবাদিক হাত উঁচু করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি পা দিয়ে বলটা খেলতে গেলেন কেন! খেলাটা যে ফুটবল নয় ক্রিকেট, সেটা কি ভুলে গিয়েছিলেন?’
এমন জেরবার অবস্থায় পড়লে সবাই একটু গুলিয়ে ফেলে। গুলিয়ে ফেলাটা শুধু খেলোয়াড়দের তরফ থেকে হয়, তা না। সাংবাদিকেরাও কখনো কখনো গুলিয়ে ফেলেন। সাংবাদিকদের এই অভিজ্ঞতা হয় বড় বড় তারকা ক্রিকেটারদের হাতে পড়লে।
একবার এক সাংবাদিক ব্রায়ান লারার পেছনে লাগলেন সাক্ষাত্কারের জন্য। লারা কিছুতেই সাক্ষাত্কার দেবেন না। আর সাংবাদিকও নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত রফা হলো—সাংবাদিকটি একটি মাত্র প্রশ্ন করতে পারবেন। সে প্রশ্নটা লারার জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর হলেও সমস্যা নেই, তিনি জবাব দেবেন।
সাংবাদিক ভদ্রলোক লারার জীবনের আদ্যোপান্ত ঘেঁটে দেখলেন, তাঁকে চরম বিব্রত করার মতো একটি প্রশ্ন আছে। লারা একবার স্টিভ ওয়াহর সঙ্গে মাঠে বসে খুব তর্কাতর্কি করেছিলেন। বলা হয়, কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে লারা তাঁকে বাজে একটা গালিও দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারটা এবার ফাঁস করতে চান ওই সাংবাদিক ভদ্রলোক।
একগাল হেসে ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, ‘স্টিভ ওয়াহ আপনাকে গালি দেওয়ার পর আপনি কী বলেছিলেন?’ লারা একগাল হেসে বললেন, ‘‘প্রথমে বলেছি, ‘হাই স্টিভ’।” সাংবাদিকটি এবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর কী বললেন?’ লারা ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেছেন, ‘আপনার একটাই প্রশ্ন করার কথা ছিল। সেটা হয়ে গেছে।’
ভারতীয় এক টেলিভিশন সাংবাদিককে নিয়েও এমন বিব্রতকর কিছু গল্প প্রচলিত আছে। ভদ্রমহিলা সেই অর্থে সাংবাদিক নন, ধারাভাষ্যকার। যত না ক্রিকেটজ্ঞান, তার চেয়েও বেশি আলোচিত তিনি সাজপোশাকের কারণে। ওই ভদ্রমহিলাকে একবার এক সাংবাদিক নাকি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সেকেন্ড স্লিপ বলে কোনটাকে?’ ভদ্রমহিলা দিব্যি উত্তর দিয়ে দিয়েছিলেন, ‘কোনো ফিল্ডার ক্যাচ ধরতে গিয়ে পর পর দুবার বল ফেলে দিলে, সেটাকে সেকেন্ড স্লিপ বলে।’ ভাগ্যিস ‘সেকেন্ড স্লিপ’ মানে ভদ্রমহিলা ‘দ্বিতীয় ঘুম’ ভাবেননি!
আসলে ওই ধারাভাষ্যকারের আর দোষ কী? সাংবাদিকদের কাজই হলো আপনার মুখ থেকে তাঁর মনমতো কথা বের করা। সে জন্য সাংবাদিককে যত দূর যেতে হয়, তিনি যাবেন। মনের কথা বের করেই ছাড়বেন।
সৌরভ গাঙ্গুলী অধিনায়কত্ব আর দলে জায়গা হারিয়ে তখন খুব বিপাকের মধ্যে আছেন। সেই সময় তাঁর মনের কথা বের করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন কলকাতার এক ক্রীড়াসাংবাদিক। অনেক দিন চেষ্টা করার পর সৌরভকে পেলেন সাক্ষাত্কারে। সাক্ষাত্কারটা ছিল এ রকম—
: ভারতের খেলা দেখছেন?
সৌরভ: দেখছি তো!
: বলা হচ্ছে দ্রাবিড়কে আর অধিনায়ক রাখা হবে না। আপনার কী মনে হয়?
সৌরভ: এটা তো আমার ব্যাপার না। এটা বোর্ডের ব্যাপার।
: বোর্ড যদি এখন দ্রাবিড়কে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেয়?
সৌরভ: তাতে আমার কী বলার আছে। এটা বোর্ড আর দ্রাবিড়ের ব্যাপার।
: আপনাকে যদি আবার অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়?
সৌরভ: দেখুন, আমি এখন দলেই নেই। অধিনায়কত্ব নিয়ে ভাবছি না।
: না, ধরুন আপনাকে আবার ভারতের অধিনায়ক করা হলো।
সৌরভ: আগে করা হোক, তারপর ভাবব।
: আপনাকে অধিনায়ক করা হলে, সেটা মেনে নেবেন না?
সৌরভ: কেন মেনে নেব না! ভারতের মতো দলের অধিনায়ক হতে কে না চায়!
পরদিন সংশ্লিষ্ট পত্রিকার ক্রীড়া পাতার শিরোনাম—‘অধিনায়কত্ব ফেরত চান সৌরভ!’ এবার হুমায়ুন আজাদের যুক্তিটা একটু বোঝা গেল।
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৯, ২০০৯
Facebook comments for blogger brought to you by AllBlogTools.com